মাতৃদুগ্ধের মত প্রকৃতির ঋণও কখনো শোধ করা যায় না

ড. আবদুল আজিম শাহ্‌ | সোমবার , ২০ মে, ২০২৪ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ রব্বুল আলামিন সমগ্র সৃষ্টির (প্রকৃতি) মধ্যে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছেন। আল্লাহ প্রতিনিয়ত মানবসেবা করে যাচ্ছেন। আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নামের একটি নাম খাদেমুন। প্রকৃতির কর্ম বলতে পরোক্ষভাবে আল্লাহরই কর্ম। প্রকৃতিজুড়ে আল্লাহর অস্তিত্ব বিদ্যমান। প্রকৃতির কর্মে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাকৃতিকতা। প্রকৃতির মাধ্যমে আল্লাহর গুণ প্রকাশ পায়। যে সকল সাধক প্রকৃতির মধ্যে নিমগ্ন থেকে প্রাকৃতিকতা হাসিল করেন; তাঁদের মধ্যেও আল্লাহর গুণ ও শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

প্রকৃতির প্রতিটি কণায়কণায় তাঁর শক্তি নিহিত। কণা থেকেই সব সৃষ্টি। হযরত শেখ সাদী(.) বলেছেন, ‘যেদিন জ্ঞানচক্ষু ফুটবে সেদিন প্রতিটি পাতায় পাতায় স্রষ্টা দর্শন হবে’। প্রকৃতির পাতায় রয়েছে এক একটি সূর্য। অর্থাৎ এক একটি শক্তি। প্রকৃতির বিস্তার হয়েছে রসূলে পাক (.)’র নূর মোবারক থেকে। যেই নূর, সৃষ্টি জগত নির্মাণের পূর্বে জ্ঞানশক্তি রূপে বিরাজিত ছিল। সমগ্র সৃষ্টিকুল সৃজন হওয়ার পূর্বে আল্লাহ নিজের মধ্যে নিজে বিভোর থাকতেন। আমি শক্তিরূপে থাকতেন। প্রাচীন বুজুর্গরা এই শক্তিকে সধানামকরণ করেছেন। সধাসংস্কৃত শব্দ।সধাকে অবেস্তা ভাষায় খদা বলে। আবেস্তা থেকে খদা শব্দ পেহলভি ভাষা হয়ে ফার্সিতে ‘খোদা’ শব্দে পরিণত হয়। অর্থাৎ আমি নিজ। বিজ্ঞান যাকে বলে দ্য আল্টিমেট পাওয়ার। হঠাৎ আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ ও বিকাশ দেওয়ার চেতনা জাগ্রত হল। সাধারণত কোনো কিছু সৃষ্টি করার পূর্বে চেতনা আসে। চেতনা থেকে পরিকল্পনা, পরিকল্পনা থেকে ইচ্ছা, এরপর ইচ্ছাকে কার্যকর শক্তিতে পরিণত করতে হয়। এ শিক্ষা আমরা গ্রষ্টা থেকে প্রদত্ত। হাদিসে কুদসিতে আছে, ‘আমি গুপ্তস্থানে গুপ্ত ছিলাম, হঠাৎ প্রকাশ দেওয়ার ইচ্ছা হল, তখন নিজেকে প্রকাশ করলাম’। অর্থাৎ আল্লাহর মধ্যে চেতনা জাগ্রত হওয়ার ফলে ‘আমি শক্তি’ জ্ঞানশক্তিতে রূপান্তর হয়। যেটি সম্পূর্ণ নূর (জ্ঞান) বা বেলায়তের শক্তি। এশক্তিকে জ্ঞানশক্তিতে রূপান্তর করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমি নিজেকে খামচি দিয়ে একটি অংশ আলাদা করলাম।’ এই অংশটি আল্লাহর প্রশংসা করতে শুরু করে। প্রশংসা করতে করতে আহাম্মদ রূপে নাম ধারণ করেন। অর্থাৎ গুণকীর্তণকারী। এটি আল্লাহর এতই প্রশংসা করেছেন যে, প্রশংসা করতে করতে প্রশংসিত (মোহাম্মদ) হয়ে যান। সৃষ্টি নির্মাণের পর এ শক্তি রহমতুল্লিল আলামিন হয়ে ধরাধামে মানবীয় রূপে আগমন করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পাঠিয়েছি একখণ্ড নূর’। এই নূর বা শক্তি, হজরত মুহাম্মদ (.)। সমগ্র প্রকৃতি রসূল (.)’র নূর মোবারক থেকে সৃষ্টি। এজন্য রসূলে পাক(.) বলেন, আমি স্বয়ং আল্লাহর নূর, সমগ্র সৃষ্টি আমার নূর থেকে সৃষ্টি হয়েছে’। তিনি আরো বলেন, ‘যখন কিছুই ছিল না তখনও আমি ছিলাম। যহেতু রসূল (.) র পবিত্র নূর মোবারক থেকে সমগ্র সৃষ্টির নির্মাণ হয়েছে, অতএব সমগ্র প্রকৃতিতেও নূরের অস্তিত্ব আছে। তাই প্রকৃতিও পবিত্র। প্রকৃতি জুড়ে গ্রষ্টার অস্তিত্ব বিরাজিত। প্রকৃতির মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের সেবা করে। প্রকৃতিতে রয়েছে আল্লাহর অগণিত নেয়ামত। আল্লাহ বলেন, ‘আমার কোন কোন নেয়ামতকে তোমরা অস্বীকার করবে?’ প্রতিনিয়ত সূর্যের মাধ্যমে আলো, চন্দ্রের মাধ্যমে কিরণ, বৃক্ষের মাধ্যমে অক্সিজেন, ফলমূল, লতা পাতা দিয়ে সেবা করে যাচ্ছেন। সার্বিকভাবে পঞ্চশক্তি দ্বারা সেবা করছেন। আর পঞ্চশক্তির সংযোগ সাধন হয় বৃক্ষের মাধ্যমে। বৃক্ষের মাধ্যমে ভূমি ও ভূগর্ভস্থপানির সাথে বায়ুমণ্ডল ও আকাশের সংযোগ স্থাপিত হয়। এজন্য বৃক্ষকে বলা হয় প্রকৃতির প্রাণ। বৃক্ষ মানবের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান অঙিজেন সরবরাহ করে এবং ত্যাগ করা কার্বনডাইঅঙক্সইড শোষণসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এক মিনিটের জন্যও যদি অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, তাহলে পৃথিবীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আল্লাহ যথাসময়ে বৃষ্টি দিচ্ছে, তাপ দিচ্ছে। তাপের শতভাগের ৮০% সূর্যের ঝিল্লি শোষণ করে। অবশিষ্ট অংশের ৭০% আকাশ মণ্ডল শোষণ করে, ২০% সমুদ্র শোষণ করে ৫% সালোক সংশ্লেষণের জন্য বনস্পতি শোষণ করে, অবশিষ্ট ৫% মানব গ্রহণ করে। প্রকৃতির কী ভারসাম্য! যদি ৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৬% পেতাম, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অসম্ভব হতো। এবং মানবদেহের ৯৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। আল্লাহ প্রকৃতির মাধ্যমে নেয়ামত দিচ্ছেন তা নয়; সুরক্ষাও করছেন। প্রকৃতির ঋণ কখনো শোধ করার নয়। প্রকৃতি নীরবে, নিভৃতে মানুষের সেবা করে। কোনো প্রকার অজুহাত নেই, বিনিময় নেই, চাওয়াপাওয়া নেই। উদারচিত্তে শুধু দিয়েই যায়। পৃথিবী হলো আমাদের মায়ের মত। এর একটি নাম ধরণী। মা যেমন সন্তানকে পেটের মধ্যে খুবই নিরাপদে ধারণ করে, পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দেন; তদ্রুপ মায়ের মত ধরণীও নিরাপদে ধারণ করে রাখেন।

মাতৃদুগ্ধ যেরকম পবিত্র এবং এর ঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না; একইভাবে প্রকৃতির ঋণও কখনো পরিশোধ করা সম্ভব নয়। কীভাবে আত্মাকে উদার ও বিশাল করতে হয় তা প্রকৃতি থেকে শিখতে হয়। এজন্য সাধকগণ নিমগ্ন থেকে, প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির গুণসমূহ ধারণ করেন। উল্লেখ্যমাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের সাধক হযরত গোলামুর রহমান শাহ (.) মাইজভাণ্ডারী গভীর জঙ্গলে দীর্ঘ ১২ বছর সাধনায় নিমগ্ন হয়ে প্রকৃতির গুণ, ভাষা অর্জনসহ আল্লাহকে হাসিল করেছেন। তাইতো তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রকৃতির গুণে গুণান্বিত; তাই প্রকৃতির মত নীরব ও উদার’। এছাড়া শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক (.)মাইজভান্ডারি ও হজরত মতিয়র রহমান শাহ (.)ফরহাদাবাদিসহ অনেকেই প্রকৃতির পঞ্চতত্ত্বের সাধনায় নিমগ্ন থেকে প্রকৃতির গুণে গুণান্বিত ও ভাষা আয়ত্ত করে মওলার সাথে মিশে একাকার হয়েছেন। প্রাকৃতিকতা হাসিল করে আল্লাহর নির্দেশে এবং তাঁরই ক্ষমতাগুণে সমগ্র প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। যে প্রকৃতিকে ভালোবাসে না, যত বড় সাধক হোক না সে গ্রষ্টা থেকে অনেক দূরে। যে প্রকৃতিকে ভালোবাসে না, প্রকৃতির ঋণ স্বীকার করে না বরং দূষণ করে; তার মত মহাপাপী আর কেউ নয়। মাতৃদুগ্ধের মতো পবিত্র অমৃত গ্রহণ করেও যে প্রকৃতির গুণ অস্বীকার করে, দূষণ করে; এই পৃথিবীতে বসাবাসে তার কোনো অধিকার নেই। প্রকৃতিকে ধ্বংস করা মানে হচ্ছে নিজেকে ধ্বংস করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়া সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

যার যার অবস্থান থেকে এই দায়িত্ব পালনে ভূমিকা রাখা উচিত। শিক্ষক ছাত্রকে, পীর ভক্তদের, মসজিদের ইমাম মুসল্লিদের, নেতাগণ কর্মীদের, সার্বিকভাবে সকলেই যদি প্রকৃতির গুণ সম্পর্কে সচেতন করে, প্রকৃতিকে রক্ষায় অবদান রাখে, তাহলে প্রকৃতি অনেকাংশেই নিরাপদ থাকবে। আমাদের উচিত অনিয়ন্ত্রিত ছন্দহীন মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দ্বারা আকাশ দূষণ না করা, পাহাড় না কাটা, অপ্রয়োজনে বৃক্ষ কর্তন না করা ( বৃক্ষকে সন্তানের মত যত্ন নিতে হয়), পানি ও বায়ু দূষণ না করা; এসব আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আকাশ চার তত্ত্বকে ধারণ করে। চারতত্ত্ব দূষিত হলে আকাশও দূষিত হয়ে যায়। প্রকৃতি হচ্ছে মায়ের মত। মাতাকে এতটুকু পরিমাণ শোষণ করতে নেই, যে পরিমাণ শোষণ করলে মাতা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তদ্‌্রুপ প্রকৃতিকে এতটুকু দূষণ করতে নেই, যতটুকু দূষণে প্রকৃতির গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। এতে প্রকৃতি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে প্রকৃতি সেবা দিতে পারে না। প্রকৃতি, একটি দেশের প্রজার মত। প্রজাকে রক্ষা করা যেমন দেশের সরকারের দায়িত্ব; তদ্রুপ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করাও সরকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই সরকারের উচিত প্রকৃতি (পাহাড়পর্বত, নদীনালা, বৃক্ষঅরণ্য, সবকিছু) যেভাবে আছে সেইভাবে টিকিয়ে রাখা। আর এই মহৎ কাজে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও ভূমিকা পালন করা উচিত।

জনগণ যদি সচেতন না হয় তাহলে সরকারের পক্ষে এই মহৎ কাজ কঠিন। প্রকৃতি কিছু আশা করে না; শুধু আশা করে যেভাবে আছে সেভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। আর যদি আমরা সেটা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদেরকে মহান গ্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। বর্তমান সরকার প্রকৃতিকে রক্ষায় অত্যন্ত আন্তরিক হওয়া সত্ত্বেও সরকারেরই কিছু সংস্থা যখন অপ্রয়োজনে, কিংবা হালকা প্রয়োজনে, উন্নয়নের নামে পাহাড় ধ্বংস, বৃক্ষ কর্তন, নদীকে দূষিতসহ পানিতে বাঁধ নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক গতিকে বাধা প্রদান, সর্বোপরি প্রকৃতির গায়ে আঘাত করে, তখন প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। অতএব প্রকৃতিকে দূষণ না করে; প্রকৃতির সুরক্ষায় সকলের এগিয়ে আসা উচিত। সামনে বৃক্ষ রোপনের মৌসম। সকলে যাতে অন্তত একটি করে হলেও বৃক্ষরোপণ করতে পারি, সেই মানসিকতা সৃষ্টি হওয়া উচিত।

লেখক : সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা : প্রয়োজন জনসচেতনতা
পরবর্তী নিবন্ধড. আনিসুজ্জামান : সমগ্র বাংলাদেশকে ধারণ করেছেন যিনি