মহেশখালীর মাতারবাড়ি বন্দরে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়ানোর ঘটনাকে ইতিহাস বলে উল্লেখ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। গত মঙ্গলবার সকালে পানামার পতাকাবাহী ‘ভেনাস ট্রায়াম্প’ নামের জাহাজটি বন্দরের জেটিতে ভিড়ে বলে জানা গেছে। গত ৩০ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘মাতারবাড়িতে ইতিহাস’ শীর্ষক সংবাদে জানা যায়, বন্দরের দুজন সিনিয়র পাইলটের নেতৃত্বে শক্তিশালী টাগবোট ‘কাণ্ডারী-৮’ এর সহায়তায় জাহাজটি জেটিতে ভিড়ানো হয়। তবে মাতারবাড়ি চ্যানেলের গভীরতা বেশি থাকায় এবং জাহাজটি স্বল্প ড্রাফটের হওয়ায় জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। বহির্নোঙর থেকে জাহাজটি সরাসরি বন্দরের জেটিতে এসে পৌঁছেছে। এর আগে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রজেক্ট কার্গো নিয়ে আসা জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে।
সংবাদে জানা গেছে, জাহাজটিতে ৩১৩টি প্যাকেজে ৭৩৬ টন স্টিল স্ট্রাকচার আনা হয়েছে। এর মধ্যে স্টিলের বিম, কলাম, গার্ডার, টাওয়ার ইত্যাদি রয়েছে। এগুলো মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট অ্যানসাইন্ট স্টিমশিপ কোম্পানি লিমিটেড। ইন্দোনেশিয়া থেকে মাতারবাড়িতে আসা ভেনাস ট্রায়াম্পের দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার এবং ড্রাফট (জাহাজের পানির নিচের অংশ) পাঁচ দশমিক তিন মিটার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এ যাবত জাপানের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ বিগ-বি বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট। এর আওতায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কোল জেটি করতে গিয়ে সেখানে একটি বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতা দেখতে পায়। মাতারবাড়ি অঞ্চলে সমুদ্রের গভীরতা ১৫.৩ মিটার। বলা হয়েছে, খনন শেষে প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়ি চ্যানেলে সারাবছরই ন্যূনতম ১৮ মিটার গভীরতা পাওয়া যাবে। চ্যানেলের বাইরে সাগরের গভীরতা ৩০ মিটার। ফলে এ বন্দরে অনায়াসে বড় আকৃতির মাদার ভেসেল নোঙর করতে পারবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোপূর্বে জানিয়েছেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। আমাদের আমদানি-রফতানির ৯২ ভাগই এই বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের এগিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। এর সক্ষমতা একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে আরও বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও পতেঙ্গা বে-টার্মিনাল নিয়ে আমাদের কার্যক্রম।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ভারত ও মিয়ানমার ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় বঙ্গোপসাগর দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগর উপকূলে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ভূ-রাজনীতির কারণে তা এতদিন সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
ভারত মহাসাগরের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সামগ্রিক আয়তন প্রায় ২২ লাখ বর্গকিলোমিটার। শ্রীলঙ্কার উপকূলবর্তী এলাকা ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাঁক ঘুরে এর বিস্তার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মানচিত্র বরাবর দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা অবধি। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ লোক বাস করছে এ উপসাগর ঘিরে থাকা দেশগুলোতে। এছাড়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুটি অর্থনৈতিক জোটের মেলবন্ধন তৈরি করেছে বঙ্গোপসাগর।
মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর প্রকল্পকে একটি সময়োচিত পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলেন, বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখন আমাদের অর্থনীতির যে গতি, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে, এ অবস্থায় কর্ণফুলী নদীভিত্তিক চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভর করার অবস্থায় আমরা আর নেই। গভীর সমুদ্রবন্দর আমাদের সময়ের দাবি ছিল। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আমাদের এই বন্দরের প্রয়োজন ছিল। এটি ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। সবার প্রত্যাশা- ‘মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর’ জাতির আগামীর স্বপ্ন পূরণ করবে। তাঁরা মনে করেন, এটি হবে একটি আধুনিক বন্দর। যেহেতু এখানে বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে, সেহেতু ব্যবসায়ীরা এতে আকৃষ্ট হবেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।