মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে কক্সবাজার রেললাইন

৩০ অক্টোবরের মধ্যে শেষ হবে কাজ, ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ ট্রায়াল রান ।। ১২ নভেম্বর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারি, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে চট্টগ্রামকক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। গতকাল সোমবার সকালে মন্ত্রী কালুরঘাট সেতুর চলমান সংস্কার পরিদর্শন করেন। পরে মন্ত্রী সড়ক পথে দোহাজারী যান। সেখানে নতুন করে নির্মিত দোহাজারী রেলস্টেশন পরিদর্শন করেন। পরে রেলমন্ত্রী মোটর ট্রলিতে করে দোহাজারী থেকে নতুন নির্মিত রেলপথ ধরে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন এবং হারবাং অংশ ট্রলিযোগে পরিদর্শন করেন। কালুরঘাট সেতু পরিদর্শনে এসে মন্ত্রী সংস্করাধীন কালুরঘাট সেতু পায়ে হেঁটে পার হন। এসময় সেতুর ওপর নতুন করে কাঠামো স্থাপন ও রেললাইন বসানোর কাজ দেখেন তিনি। সেতুর বোয়ালখালী অংশে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, আগামী ২ নভেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে এই রুটে চট্টগ্রাম থেকে কঙবাজার পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ একটি ট্রেন চালানো হবে। আগামী ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন।

রেলমন্ত্রী প্রথমে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেলসেতুর সংস্কারকাজ পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কঙবাজার পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে দোহাজারী এলাকায় যান।

কালুরঘাট সেতু সংস্কার কাজ পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এই ট্রেন লাইন নির্মাণে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। করোনার সময় কাজে ব্যাঘাত হয়েছে। সর্বশেষ বন্যার সময়ও রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপরও আমরা কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক রেল লাইনের উদ্বোধন করবেন। তার আগে ২ নভেম্বর আমরা চট্টগ্রাম থেকে কঙবাজার পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ একটি ট্রেনের ট্রায়াল রান করবো।

জরাজীর্ণ রেলসেতুটির প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এটা অনেক পুরনো ব্রিজ। ট্রেন চলে। আবার বিভিন্ন যানবাহনও চলে। আমরা এখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য আলাদা করে একটি লেন করে দিচ্ছি। ৬ ফুট আলাদা ওয়াকওয়ে করে দেওয়া হচ্ছে। সেটি হতে আরও দুয়েক মাস সময় লাগতে পারে। আগে মূল ব্রিজের সংস্কার কাজ শেষ হবে। এরপর ওয়াক ওয়ের কাজ শুরু হবে। সেটা চালু হতে আরও ২৩ মাস লাগতে পারে। তবে তার আগেই মূল ব্রিজটা ট্রেন চলাচলের উপযোগী হবে। নতুন সেতু নির্মাণের আগ পর্যন্ত এই পুরনো সেতু হয়ে চট্টগ্রামকঙবাজার রুটে ১৫ টনের ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চলবে। আগামী ২০ বছর ঝুঁকিমুক্তভাবে ট্রেন চলতে পারবে।

রেলমন্ত্রী বলেন, এছাড়া এখানে নতুন একটি ব্রিজ হবে। এটা এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। ডুয়েল গেজ রেললাইন এবং ফোর লেইনের সড়কসহ সেতু হবে। আগামী বছর কাজ শুরু হতে পারে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ব্রড গেজ ট্রেন এখন চালাতে পারবো না। ঢাকাকে মূল ফোকাসে রেখে দেশের আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ করেছি। এদিকে দোহাজারী থেকে কঙবাজার পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে দোহাজারী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম এবং আখাউড়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ করা হবে। এটি ধীরে ধীরে হবে। এই সময়ের মধ্যে আশা করছি কালুরঘাটে যে নতুন ব্রিজ করতে যাচ্ছি তা হয়ে যাবে।

দোহাজারীতে পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রকল্পের কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি দেখার জন্য এসেছি। কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যেটুকু বাকি আছে সেটা ৩০ তারিখের (অক্টোবর) মধ্যে হয়ে যাবে। সিগন্যালিং সিস্টেমটা চালু হয়ে যাবে। ট্রেন চালানোর জন্য লাইনটা পুরোপুরি উপযোগী হয়ে যাবে। দু’য়েকটা স্টেশনের কিছু কাজ হয়তো বাকি থাকবে।

ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাত্রীবাহী ট্রেন কতটি চলবে, মালবাহী ট্রেন এবং ভাড়ার বিষয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর নির্ধারণ করা হবে। তবে আমরা উন্নত যাত্রীবাহী কোচ দেয়ার বিষয়টি যাচাইবাছাই করছি।

রেলপথের সুফল প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, মানুষ বিমানেসড়ক পথে কঙবাজার যায়। মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ট্রেনে করে কঙবাজার যাবে। সারা দেশের মানুষের এই রেলপথ নিয়ে আগ্রহ, ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা সবসময় সাশ্রয়ী নিরাপদ ও আরামদায়ক। এর জন্য এই প্রকল্প। যাত্রীরা আশা করি উপভোগ করবে। এ সময় রেলমন্ত্রী আরও বলেন, দোহাজারীকঙবাজার রেললাইন ভবিষ্যতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। কাজেই বহুবিধ ব্যবহারের জন্য এটা করা হচ্ছে।

পর্যটকদের জন্য পর্যটন ট্রেন বা কোচ দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী সুজন বলেন, পর্যটন নগরীর সাথে উন্নত যাত্রীবাহী কোচ দেওয়ার উপযোগী করে কাজ করছি। এখনো পর্যন্ত ভাড়া নির্ধারণ হয়নি। আমরা যাচাই বাছাই করে এটা করব। ১২ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরে যাত্রীবাহী ট্রেন চালানোর জন্য ভাড়াটাড়া যা যা আছে সেগুলো আমরা দেখব।

পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী মোটর ট্রলিতে করে দোহাজারী থেকে নতুন নির্মিত রেলপথ ধরে কঙবাজারের উদ্দেশে রওনা হন।

এই রেলপথ নির্মাণের আগে কঙবাজারের সাথে দেশের বাকি অংশের রেল যোগাযোগ ছিল না। শুরুতে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কঙবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণের যে প্রকল্প নেওয়া হয়, তাতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কথা ছিল।

পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কঙবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। তাতে ব্যয় হবে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা দিচ্ছে এবং বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্পের জন্য দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কঙবাজার অংশে কঙবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, ৪টি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বঙ কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।

বর্তমান সরকার ২০১০ সালে প্রকল্পটির প্রথম অনুমোদন দেয়। তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ করার কথা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। পরে জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এডিবিকে প্রস্তাব দেয় সরকার।

এডিবি বিশদ সমীক্ষা পরিচালনা করে ট্রান্স এশিয়ান রেল লাইনের আওতায় প্রকল্পটিতে অর্থায়নে সম্মতি দেয়। এরপর ২০১৭ সালে প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির ব্যয় ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। মহামারীর সময় কাজের অগ্রগতি প্রত্যাশিত না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত হলেও ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বহুল প্রত্যাশিত এ রেল লাইনে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন। তবে বাণিজ্যিক ভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে ডিসেম্বর থেকে।

চট্টগ্রামকঙবাজার রেললাইন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন জানান, ইতোমধ্যে রেললাইনের মূল কাজ শেষ। সার্বিকভাবে কাজ শেষ হয়েছে ৯২ শতাংশ। অবশিষ্ট ৮ শতাংশ কাজ হলো আমাদের কিছু স্টেশনের কাজ বাকি রয়েছে। সিগন্যালিংয়ের কিছু কাজ বকি আছে, সেগুলো চলছে। কিছু স্টেশনের ফিনিশিং ওয়ার্কের কাজ চলছে। কঙবাজার স্টেশন বিল্ডিংয়ে আমাদের অপারেশনাল কাজ চলার মতো তৃতীয় তলা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ ৩০ অক্টোবরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

কালুরঘাট সেতুসহ দোহাজারীকঙবাজার রেল লাইন পরির্দশনে মন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন, দোহাজারীকঙবাজার রেললাইনের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মফিজুর রহমান, দোহাজারীকঙবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ব্রিজ) মো. আব্দুস সালাম, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী জিসান দত্ত প্রমুখ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকালুরঘাটে নতুন রেল কাম সড়ক সেতুর কাজ শুরু আগামী বছর
পরবর্তী নিবন্ধদেওয়ান বাজার ওয়ার্ড সচিবকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত