মানব সভ্যতার বিস্ময় শ্বাশত মাইজভান্ডারী দর্শন। একজন বাঙালি সুফি সাধক কর্তৃক বাংলার জমিনের ভূ–প্রকৃতি এবং পরিবেশের আদলে তাওহীদের প্রতি আনুগত্য পকাশ ও সমবেত হওয়ার আহবানে প্রবর্তিত একমাত্র তরিকার নাম মাইজভান্ডারী তরিকা।
মহাসমুদ্র রূপ মাইজভান্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক অনুসঙ্গ সামা‘ তথা মাইজভাণ্ডারী সঙ্গীত মাইজভান্ডারী তরিকার সাধন মার্গের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে এই গানের সৃষ্টি।
আল্লাহর নিরানব্বাই নামের কোন একটি বা কোরআন শরীফের কোন আয়াত পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করার নাম মিকির। আল্লাহর প্রেমমূলক এই সংগীতকেই সামা‘ বলা হয় ।
আত্মার উন্নতির জন্য এবং রুহানিয়াতের বিকাশে, বস্তুবাদী চেতনার বিলোপ ও প্রবৃত্তি তাড়িত সুরের ইন্দ্রজাল ছিন্ন করে সংগীত প্রেমী মানুষকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিকতার পথে ধাবিত করতে মাইজভান্ডারী সংগীত যুগের পরিবর্তিত রূপ। মাইজভান্ডারী গান উপভোগের নয়, উপলব্দির। সকল তরিকাকে বেস্টনকারী মহাসমুদ্ররূপী মাইজভান্ডারী তরিকার দার্শনিক ধারার রূপায়নে তত্ত্বক, আলোচনার বিশ্লেষণে, শ্রোতার বোধগম্যতার কাছাকাছি যাওয়ার ক্ষেত্রে এ মাইজভান্ডারী সঙ্গীতের ভূমিকা বিশাল। মাইজভান্ডারী দর্শন বা তরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘সামা মাহফিল‘ আর এ সামা মাহফিলের অন্যতম উপাদান হচ্ছে মাইজভান্ডারী মরমী গান বা সংগীত। মাইজভান্ডারী গান হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক সঙ্গীত যা স্রষ্টার প্রেমে ভক্তকুলের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে ভাব–বিহবলতায় বিভোর করে দেয় এবং স্রষ্টার নৈকট্য হাসিলে সহায়তা করে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির যোগসূত্র স্থাপন করে। ভক্তকুলের হৃদয়– মনকে অনাবিল স্বর্গীয় পবিত্রতায় ভরে দেয়। মাইজভান্ডারী গানের একটি অনুপম ও অতুলনীয় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এ গানের কথা, সুর, তাল ও লয় ।
মহান আল্লাহতায়ালা দয়ার নজরে আম খাস প্রত্যেককে দেখে থাকেন এবং সকল সৃষ্টিকে সৎপথ প্রদর্শন করে থাকেন। দৃঢ় বিশ্বাস সম্পন্ন সত্যবাদীর অন্তঃকরণে সৃষ্ট আলোর বদৌলতে ব্যক্তিদের দীলের মধ্যে জোস্‘ এক্ষ–মহব্বত‘, ‘জজবা‘ বা প্রেরণার অনুভূতি আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘অজুদ‘ ও ‘হরকত‘ প্রস্ফুটিত হয়। তখন উক্ত ব্যক্তিগণ নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যদ্বারা হরকত আসে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং সৎ উদ্দেশ্যেই রাগ গান শ্রবণের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন। যেহেতু আল্লাহপাক গান শুনা, বাজনার আওয়াজ এবং সমস্ত রাগের মধ্যে এমন এক গুপ্ত রহস্যাবৃত আমানত রেখেছেন, যদ্বারা প্রজ্জ্বলিত আশেকানের জন্য প্রেমাগ্নিতে দগ্ধ হবার স্বাদ রয়েছে। সুতরাং রাত–দিন এটা শুনার জন্য তারা সমবেত হয় এবং সৎ উদ্দেশ্যে খালেস নিয়তে বিনা দ্বিধায় ও ইনকার ব্যতীত রাগ গান শুনে থাকে। তখন তাদেরকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হরকত–নৃত্য করতে দেখা যায়। এই সামা উক্ত পুণ্যবান ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভের প্রধান সহায়। ইতিমধ্যে উপরোক্ত স্রষ্টার মাহাত্ম্য আমরা জেনেছি, এ মহান তরিকাপন্থীদের প্রধান অনুষঙ্গ ‘সেমা‘ বা সুসংগীত চর্চা। রুহে হাইওয়ানিয়ার বা কু–রিপুতাড়িত বিশ্বব্যাপী ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে মাইজভান্ডারী মাহফিলের ‘সামা‘ শুধু একটি প্রস্তাবনা নয় বরং অনিবার্য। মাইজভান্ডারী গানের পবিত্র আবহ মানুষের হৃদয়ে প্রবিষ্ট করে বিবেককে নাড়া দেয়, পাশবিকতাকে করে সুপ্ত মানবিকতাকে করে উজ্জীবিত।
ডাঃ এনামুল হকের মতে, সামা বা সংগীতের সাহায্যে আল্লাহর মহিমাকীর্তন চিশতীয়া খান্দানের বৈশিষ্ট্য। তাঁর মতে মওলানা জালাল উদ্দীন রুমির ‘মৌলবীয়া তরিকা এবং খাজা মঈন উদ্দীন চিশতি ‘চিশতিয়া তরিকার‘ সমন্বিত যোগ এই মাইজভান্ডারী তরিকা। হালকা বা বৃত্তাকার নর্তন মৌলানা রুমি প্রবর্তিত ‘মৌলবীয়া সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য আর সেমা বা সংগীতের সাহায্যে খোদার মহিমাকীর্তন চিশতিয়া খানদানের বৈশিষ্ট্য। সংগীতের মূর্ছনা অন্তরে আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, এবং মনকে আল্লাহর ধ্যানে নির্বিষ্ট করতে সাহায্য করে। হামদ, নাত, গজল, মুর্শিদী, মারফতি, কাওয়ালী, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি সংগীত সেমা‘ বা বিশুদ্ধ সংগীতের পর্যায় ভুক্ত প্রকৃতপক্ষে সামা শ্রবণ কারককে আধ্যাত্মিক জগতের এক ভাব উন্মাদনার পর্যায় নিয়ে যায়।
গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের বিভিন্ন মজাকীর বৈজ্ঞানিক রুচি সম্পন্ন জাতি ও ধর্মের সমাবেশ ও সংমিশ্রণ স্কুলে আত্মপ্রকাশিত মোজাদ্দেদ আউলিয়া। তাই তিনি গান বার্জনা ও গজল গীতিকে স্থান কাল পাত্র ভেদে জিকিরের উপাদান ও হেকমতে অনুমোদন ও অনুমতি দিতেন।
যুগ সংস্কারক অলীয়ে কামেলগণ মানবজাতিকে নানা প্রকার হেকমত প্রয়োগে আল্লাহতালার মহিমার প্রতি আহবান করে থাকেন। স্থান বিশেষে তাল বাদ্য যন্ত্রাদি সহকারে গজল, নাতীয়া ইত্যাদি ছন্দে বন্দে গেয়ে মানবকুলের মনে আল্লাহ রাসূলের প্রেম–প্রেরণা জাগিয়ে তালে তালে “জিকিরে জলী‘ (০১) বা খফী” (০২) করাকে কোন কোন অলি–আউলিয়া হেকমত হিসেবে গ্রহণ করেন।
*ওয়াদয় এলা ছবীলে রব্বেকা বিল হেকমতে ওয়াল মওএজাতিল হাছান‘ অর্থাৎ খোদার দিকে জনগণকে হেকমত কৌশল ও সৎকার্যে উৎসাহপূর্ণ কথা দ্বারা আহবান করা। ইহা সকল ধর্মাবলম্বী মনঃপুত ও সর্বযুগোপযোগী মানব দানব এমন কী জীব জন্তু পর্যন্ত রূহানী মনঃপুত কৌশল।
জলি অর্থ সশব্দে প্রকাশ্যে যাকে জিকরে জবানী বলে। খফি অর্থ অন্তরে, নিঃশব্দে যাকে জিকরে কলবি বলে।
মঈনুদ্দীন চিশতী (কঃ) পাক ভারতে এসে ভারতবাসীকে বাদ্য প্রিয় মাজাকী রুচি সম্পন্ন দেখে তাহাদের রুচি অনুযায়ী বাদ্যযন্ত্রকে তরীকতের উপদান ও হেকমত হিসেবে গ্রহণ ও অনুমোদন করে ভারতবাসীকে হেদায়ত করতে সক্ষম ও সফলকাম হয়ে ছিলেন।
এইরূপ গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) একই কারণে অবস্থা বিশেষের জন্য উপরোক্ত হেকমত বা কৌশল অনুমোদন করেন। যেহেতু ইহা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নদীর স্রোতের মত ভাবপ্রবণতার ভিতর দিয়া খোদা প্রেম–বিভোর মহাসাগরের সঙ্গে সংযোজিত করতে কার্যকরী তাই ইহা খোদা–প্রেম পথচারীকে বাজে ধ্যান ধারণা হতে ফিরিয়ে এনে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। যাকে ছফি পরিভাষা মতে “হুজুরে বলব” ও বাংলা ভাষার একাগ্রচিত্ততা বলা হয়। যার অভাবে কোন এবাদত বা উপাসনা শরীয়ত মতে ছহীহ হলেও খোদার দরবারে গৃহীত হয়না।
গজল গীতির সুরে ও বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে একাগ্রচিত্তে খোদার প্রেম–প্রেরণা জাগ্রত অবস্থায় ভক্তকুলের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জাগ্রত হয়ে জিকির করতে থাকে। কাহাকেও এই সময় “হালকা” বা হেলে দুলে নৃত্য অবস্থায় দেখা যায়, কেহ বা জিকিরে কলবী দ্বারা খোদা–প্রেমে বিভোর হয়ে পড়ে।
পবিত্র কোরআন পাকের বাণী:
(আল্লাজীনা ইয়াজ কুরূনাল্লাহা কেয়ামান, ওয়াকুয়োদান ওয়া আল্লা জনুবেহিম) অর্থাৎ যাহারা দাঁড়িয়ে বসে বা কোন অবস্থায় খোদাকে স্মরণ করে। পবিত্র হাদিসে শরীফে বর্ণিত আছে: ‘জজবাতুন মিনাল্লাহ্ খাইরুম মিন আমালিছ ছাকলাইন‘ অর্থাৎ খোদার একটি জজ বা প্রেম বিভোর অবস্থা দুই জাহানের এবাদত হতে শ্রেষ্ঠ।
অতএব, গুণী, জ্ঞানী, তত্ত্ববিদ, আলেম, মহিয়সী গবেষক এবং মাইজভান্ডারী তরিকার গুণগ্রাহী লোকজন মনে করেন এ গান মানবজাতিকে হেলেদুলে নৃত্য দেখাতে আসে নাই, বরং অনাসক্ত ইন্দ্রিয় সত্তা প্রকৃতিষ্ঠ মানব মনে খোদা প্রেমে বিভোর ধর্মপ্রাণ জাতিরূপে খোদার একান্তে সমাবেশ করতে এসেছে।
মাইজভান্ডারী গানের মাহাত্য তার শব্দ সৌন্দর্য, বাক্য সৌন্দর্য, ভাব সৌন্দর্য, সুর সৌন্দর্য, নিপুণ গঠনশৈলী সমৃদ্ধ হৃদয়গ্রাহী গান। প্রেম ভক্তি, ভাব নিবেদন, আবেদন বিনয়, সমর্পণ, স্বপ্ন, মুক্তি, উপদেশ, বিচ্ছেদ, বিরহ, যন্ত্রণা, আকুতি বিবিধ আবহে ভরপুর এই মাইজভান্ডারী গান। এখানে উশৃঙ্ক্ষলতা, অশ্লীলতা, নোংরামী বা কুরুচিপূর্ণ প্রেম ভাবের যেমন স্থান নেই তেমনি এ সকল গানের অঙ্গহানির অপপ্রয়োগ, পরিবেশনা, ধারণ ও প্রচারের কোন সুযোগ নেই।
মাইজভান্ডার মানে ভক্তির ভান্ডার, ভাবের ভান্ডার, সুরের ভান্ডার, রসের ভান্ডার, দয়ার ভান্ডার, নুরের ভান্ডার, গুণের ভান্ডার, মুক্তির ভান্ডার, ধনের ভান্ডার, প্রেমের ভান্ডার, মায়ার ভান্ডার, জ্ঞানের ভান্ডার, সাধনার ভান্ডার, রূপের ভান্ডার, রসিকের ভান্ডার, আশেকের ভান্ডার, বিশ্বাসের ভান্ডার, ভক্তের ভান্ডার, তালের ভান্ডার, শ্রীলের ভান্ডার মাইজভান্ডার।
যে সকল গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছে : ১। সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান কর্তৃক প্রকাশিত ড. সেলিম জাহাঙ্গীর সম্পাদিত বই, মাওলানা হাদীর মাইজভান্ডারীর গান সমগ্র, আলোকধারা বুকস, চট্টগ্রাম। প্রকাশ ২৪শে ডিসেম্বর ২০১৭, পৃষ্ঠা ৯, ১০, ১৫, ১৭, ১৮। ২। বেলায়েত মোতলাকা– সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন আল মাইজভান্ডারী, প্রকাশ নভেম্বর ১৯৮০, পৃষ্ঠা– ১৭৯ – ১৮২। ৩। সুফীবাদ, অধ্যাপক আবদুল মালেক নুরী, ৪। তোহফাতুল আখইয়ার ফি দাফ–ই শারারাতিল আশরার সেমা বা গান বাজনা সম্বন্ধীয় ফতোয়া, রচয়িতা মুফতীয়ে ফরহাদাবাদী (রা) ফরহাদাবাদ দরবার শরীফ, ফরহাদাবাদ, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
লেখক : সংগীতশিল্পী ও প্রাবন্ধিক