জাতীয় কবি নজরুলের কবিতা ‘হিন্দু–মুসলমান’ কবিতার পংক্তি উচ্চারণে নিবন্ধের সূচনা করতে চাই। ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু–মুসলমান।/ মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তার প্রাণ।/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে যেন রবি শশী দোলে,/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।/ এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,/ এক সে মায়ের বক্ষে ফলে এক ফুল ও ফল।/ এক সে দেশের মাটিতে পাই কেউ গোরে কেউ শশ্মানে ঠাঁই।/ মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান।/ চিনবে নেরে আঁধার রাতে করি মোরা হানাহানি, সকাল হলে হবে রে ভাই ভায়ে ভায়ে জানাজানি।/ চাইবো ক্ষমা পরস্পরে, হাসবে সেদিন গরব ভরে এই হিন্দুস্থান।’ মূলত: অন্য ধর্মে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও ধর্মের রীতি–নীতি, আচার–অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতি পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান প্রদান ও এই ধারণাকে মর্যাদাসীন করার লক্ষ্যে মানবিকতায় উজ্জীবিত চেতনার নামই অসাম্প্রদায়িকতা। এই জনপদে হিন্দু–মুসলমান–বৌদ্ধ–খ্রিস্টানসহ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ ও সাবলীল বসবাস এই জাতির আবহমান সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট পরিচায়ক। বাংলা ভুখন্ডে প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর ঈদ–রোযা–মহরম–পূজাপার্বণ–বড়দিন–বৌদ্ধপূর্ণিমার সমীকরণে স্বজাত্যবোধের পরিচিতি নিরন্তর নন্দিত এবং প্রশংসিত।
মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মহামনীষীদের জীবনচরিত ও আদর্শ–চলৎশক্তির পরিচর্যা–অনুকরণ ও অনুশীলন সমধিক প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) সম্পর্কে খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মুর বলেছিলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে যুগে এই ধরিত্রীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন; তিনি শুধু সেই যুগেরই মনীষী নন বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনীষী। সমাজের সামগ্রিক অসঙ্গতি, শোষণ, অবিচার, ব্যাভিচার, সুদ–ঘুষসহ অপরাধমুক্ত সকলের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, আত্নার পবিত্রতা ও মহত্ত্ব, ক্ষমা, ধৈর্য্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও অবিচল কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে দীপ্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি অনুপম উপমায় বিশ্বশীর্ষ ভূষণায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ও পবিত্রতম আরাফাত ময়দানে প্রায় এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার সাহাবীর সম্মুখে বিদায় হজ্জ খ্যাত ভাষণের শুরুতেই সম্ভোধন করেছিলেন ‘হে বিশ্ব মানবকূল’ অর্থাৎ কোন বিশেষ সম্প্রদায়, জাতি–রাষ্ট্র বা ধর্ম–বর্ণ নয়, মহান স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা সমগ্র মানব সমাজের উদ্দেশ্যেই তাঁর এই ভাষণ ছিল বিশ্বশ্রেষ্ঠ মানবাধিকার সনদ। পবিত্র কোরআনে মহান স্রষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন; তিনি কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত স্বরূপ পৃথিবী নামক এই গ্রহে আবির্ভূত হয়েছেন। উল্লেখ্য পূত–পবিত্র ভাষণের তদ্ভাব তপস্যা ছিল; বৈষম্যহীন জাতি–রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আভিমুখ্য জ্ঞানাঞ্জন–মানুষের পারস্পরিক সৌহার্দ–সম্প্রীতি–ধনসম্পদ ও মান–মর্যাদার রক্ষাকবচ। প্রিয় নবীর এই মহামূল্যবান অমীয় ভাষণকে বিশ্বের সকল ধর্ম–বর্ণ–দলমত–অঞ্চল–নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কাছে পরম গ্রহণযোগ্য প্রেষণা ও অনুপ্রেরণা।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সুনামগঞ্জের সভায় বঙ্গবন্ধু অতি আবেগী ভাষণে বলেছেন, ‘এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আপনারা সুখে বাস করবেন। পাশাপাশি বাস করবেন। ভাই ভাই বাস করবেন। কোনোও মতে যেন সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মাটিতে আর না হয়। তাহলে আমি হার্টফেল করে মারা যাবো। কারণ জীবন ভরে আমি সংগ্রাম করেছি মানুষের মঙ্গলের জন্য। মুসলমান ভাইয়েরা, আল্লাহ কিন্তু রাব্বুল আল আমিন আল্লাহ কিন্তু রাব্বুল মোত্তেকিন। সমস্ত মানুষের সে খোদা। কোনোও সম্প্রদায়ের সে খোদা নয়। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, সাম্প্রদায়িক এর বীজ যেন বাংলার মাটিতে বপন না করে। তাহলে ত্রিশ লক্ষ যে শহীদ হয়েছে ওদের আত্মা শান্তি পাবে না।’ উপরোল্লেখিত বক্তব্য থেকে অতি সহজে অনুমেয় যে বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন তার স্বরূপ উম্মোচিত ও পরিপূর্ণতা পাবে যেদিন বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা–দারিদ্র–শোষণমুক্ত মানবিক সমাজের অবস্থানে পৌঁছে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে গাউসুল আজম শাহ সুফী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) প্রবর্তিত একমাত্র তরিকা হচ্ছে মাইজভান্ডারী দর্শন। মহান আল্লাহ প্রেরিত পবিত্র কোরআন এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনাদর্শের অমূল্য অনুষঙ্গগুলোকে যথার্থ ধারণ–অনুসরণ–পরিচর্যার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন মাইজভান্ডারী দর্শনের মৌলিক ভিত্তি। উপমহাদেশের প্রধান আধ্যাত্মিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র মাইজভান্ডার দরবার শরীফ। এটি কেবল একটি দর্শন, পারলৌকিক সাধনা কিংবা চেতনার নাম নয় বরং একটি মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক এবং বিচারসাম্য মূলক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রাম। এ দর্শন সব ধরনের গোঁড়ামি ও মানবতাবিরোধী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক–রাজনৈতিক–ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক বিপ্লব। মাইজভান্ডার দর্শনে ধর্ম সাম্যের যে বাণী তার যথার্থ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় এর প্রবর্তক শাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ)’র কর্মকান্ডের মধ্যে। তিনি জাতি–ধর্ম–বর্ণ–গোষ্ঠীর সকলকে স্ব–স্ব ধর্মে থেকে কাজ করার ও আল্লাহকে স্মরণ করার পরামর্শ দিতেন। সম্প্রদায়গত ভেদ বুদ্ধির উর্ধ্বে তার কর্মকান্ড সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রচন্ড প্রভাবিত করে। ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ সকল ধর্মের মানুষের অপরূপ মিলন কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়।
মাইজভান্ডার দরবার শরীফ থেকে প্রকাশিত হযরত বাবাভান্ডারী গ্রন্থের ভূমিকায় উপস্থাপিত বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আবুল ফজল বলেন, ‘মাইজভান্ডার চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার এক অজপাড়া–গাঁ, বাংলাদেশের অগন্য গ্রামের নগন্য একটি গ্রাম মাত্র। আজ কিন্তু একে নগন্য বলার কোনো উপায় নেই; কিছুতেই অভিহিত করা যাবেনা অজপাড়া–গাঁ বলেও। পৃথিবীর মানচিত্রে মাইজভান্ডার আজ নিজের স্থান নিজেই করে নিয়েছে। এ নাম আজ ছড়িয়ে পড়েছে দিগ দিগন্তে। বিশেষ করে পাক ভারতে এই নাম আজ ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত; লক্ষ ভক্তের কন্ঠে আজ এই নাম উচ্চারিত সশ্রদ্ধচিত্তে। মাইজভান্ডার শরিফের মধ্যমণি মরহুম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহ আর মরহুম সৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ। আধ্যাত্মিক সাধনায় এঁরা ছিলেন সিদ্ধপুরুষ, কামেল অলিআল্লাহ। এঁদের আধ্যাত্মিক সাধনার মহিমায় কালক্রমে মাইজভান্ডারকে উন্নীত করেছে মাইজভান্ডার শরীফে। এখানে এসে হাজার হাজার ভক্ত নিজেদের আধ্যাত্মিক ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিবারণ করে থাকে প্রায় শত বৎসর ধরে। নর–নারী জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে মাইজভান্ডার আজ অগন্য ভক্তের মিলনকেন্দ্র, এক মহাতীর্থভূমি। ইসলামে মারাফত বা আধ্যাত্মিক সাধনার বহু তরিকা রয়েছে। মাইজভান্ডার শরীফে যে তরিকা অনুসৃত হয় তার মূলকথা প্রেম ও ভক্তি। তাই কোনোরকম জাতি–ধর্ম–মাযহাবের ভেদাভেদ নেই এখানে। এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা সবাই প্রেম ভক্তি পথের পথিক; সবাই এক ও সবাই সমান। মাইজভান্ডার প্রেম ও ভক্তিমার্গের এক অপূর্ব সমন্বয়ক্ষেত্র।’
মানবপ্রেম, সামাজিক কল্যাণ ও আত্মিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এর ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। মাইজভান্ডারী জীবন দর্শনের চেতনা মানবতাবাদী মানুষকে প্রচন্ড আলোড়িত করার পাশাপাশি এর সংগীতের সুর বিশ্ব সংগীত জগতকে প্রভাবিত করেছে। মাইজভান্ডার দরবার শরীফকে কেন্দ্র করে শাশ্বত মরমী বাংলা লোক সংস্কৃতির অবয়বে নতুন রঙে–সুরে–রূপে আবির্ভূত রয়েছে বিশ্বের লৌক সংস্কৃতির সুবিশাল চত্বর। প্রাসঙ্গিকতায় উপরোল্লেখিত একই সূত্রমতে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাইজভান্ডারী সাধনা যেমনি ইসলামের সৌন্দর্য ও ভিত্তিকে গণমুখী করেছে, তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় সংযোজিত করেছে একটি স্বতন্ত্র সাংগীতিক উজ্জীবনে। সঙ্গীতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও পীরের স্বরণ মাইজভান্ডারী ধারার একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পময়তা– যা বাঙালি সংস্কৃতিকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।’
হযরত মাওলানা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) যুগান্তকারী মাইজভান্ডারী দর্শনের সমন্বয়সমৃদ্ধ বিশ্বমানবতার মিলন মন্ত্রের যে বীজ বপন করেছিলেন তাঁর পরলোকগমনের পর তারই ভ্রাতুস্পুত্র ইউসুফে ছানী হযরত গাউছুল আযম সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাভান্ডারী (কঃ) অধিকতর শোভিত ও বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণ বিকাশে সার্থক রূপদানে ব্রতী ছিলেন। ধারাবাহিকতায় মাইজভান্ডারী দর্শনের স্বরূপ উম্মোচক ওছীয়ে গাউছুল আজম হযরত দেলোয়ার হোসেন মাইজভান্ডারী (কঃ) এবং সর্বোপরি তাঁরই পুত্র শাহানশাহ হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ)’র নির্লোভ–নির্মোহ–মানবকল্যাণে সামগ্রিক নিবেদন–দেশপ্রেমের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় অলৌকিক আধ্যাত্মবাদের আলোকে অসাম্প্রদায়িক–মানবিক বাংলাদেশসহ বিশ্বপরিমন্ডলকে অত্যুজ্জ্বল করার মানসে যে অভূতপূর্ব অবদান রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয়। বিগত শতাধিক বছর ধরে মাইজভান্ডারী দর্শন পাপী–তাপী, শোষিত–নির্যাতিত–অবহেলিত, মোহান্ধ, পথ–নীতিহারা, দীনহীন মানবতার আশ্রয়স্থল–পদপ্রদর্শক, আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় ও ধর্ম সাম্যের সংগীত গেয়ে আধ্যাত্মিক লৌকিক, পারলৌকিক শান্তির ঠিকানা হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। আজকের এই দিনে মাইজভান্ডারী দর্শনের প্রবর্তক হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) কেবলা কাবার ১১৬তম ওরশ মোবারক উপলক্ষে মহান স্রষ্টার দরবারে বিশ্ববাসীকে সর্বাত্মক শক্তি–সাহস ও সচেতন অভিপ্রায়ে করোনা অতিমারী প্রতিরোধে জয়যুক্ত কারার প্রার্থনা নিবেদন করে নিবন্ধের ইতি টানছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।