ঢাকা– চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি এলাকা। গতকাল হাইওয়ে পুলিশের একটি টিম অবস্থান করছিল রাস্তায়। যানবাহনের তেমন চাপ নেই। ঢাকামুখী নানা গতির গাড়ি ছুটছে দুই লেনের ওয়ান–ওয়ে ধরে। পুলিশ একটির পর একটি গাড়ি সিগন্যাল দিচ্ছিলো। ৮৮ কিমি স্পিডে চলা একটি প্রাইভেট কারের চালককে আটকায় পুলিশ। ওই চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ– ওভারস্পিডে গাড়ি চালিয়েছে। ওইখানে নির্ধারিত গতিবেগ ৮০ কিমি। ড্রাইভার যুক্তি দিচ্ছিলেন, ফাঁকা রাস্তা, তাই একটু স্পিড বাড়িয়েছে, কমে চালালে তো পেছনের গাড়ি ধাক্কা দেবে। পুলিশ বলছে– রাস্তা ফাঁকা হলেও নির্দিষ্ট স্পিডের বেশি গাড়ি চালানো বেআইনি, অপরাধ। মামলা দিলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা। পরে অবশ্য মামলা হয়নি।
অভিজ্ঞমহল মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক মহাসড়কের গতিসীমা পুনঃনির্ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের স্পিডলিমিট ৯০ থেকে ১০০ কিমি করা উচিত। চার লেনের এই মহাসড়কে ৮০ কিমি স্পিডে গাড়ি চালানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে সরকার বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। নির্ধারিত স্পিডের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো অপরাধ।
এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তিন মাসের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার শাস্তির কথা বলা হয়েছে আইনে। একইসাথে চালকের লাইসেন্সের এক পয়েন্ট কাটা পড়ার বিধান রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সড়কে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি এই অপরাধ করলেও সিংগভাগই ম্যানেজ করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী কোন সড়কে কোনো ধরনের যানবাহন কত স্পিডে চলবে তা ঠিক করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগ থেকে ‘মোটরযানের গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২৪’ শীর্ষক একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। উক্ত নির্দেশিকা অনুসরণ করে দেশের রাস্তাগুলোতে যানবাহন চলার কথা। ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে গতি সংক্রান্ত এই নির্দেশনা জারি করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী, এঙপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার, ট্রাক ৫০ কিলোমিটার এবং মোটরসাইকেল ৬০ কিলোমিটার। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে। অন্য গাড়িগুলো চলতে পারবে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার বেগে।
সড়কগুলোকে পৃথক ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি এ) প্রাইভেটকার, এসইউভি, মাইক্রোবাস, বাস, মিনিবাসসহ হালকা যানবাহনগুলো সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে। ট্রাক, বাইক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
জাতীয় সড়কে (ক্যাটাগরি বি) প্রাইভেটকার, এসইউভি, মাইক্রোবাস, বাস ও মিনিবাসের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার, বাইকের জন্য ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য ৪৫ কিলোমিটার। জেলা সড়কে বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার, বাইক ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার গতি নির্ধারিত রয়েছে।
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা শহরের ভেতরের রাস্তায় প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন হালকা যানবাহন, বাস ও মিনিবাস সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার এবং ট্রাক, মোটরসাইকেল ও আর্টিকুলেটেড লরি ৩০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে। স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার ও আবাসিক এলাকার কাছাকাছিতে জাতীয় সড়কে ৪০ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩০ কিলোমিটারের বেশি বেগে কোনো গাড়ি চালানো যাবে না।
এই নির্দেশনা অমান্য করে কেউ বাড়তি গতিতে গাড়ি চালালে সড়ক পরিবহন আইন–২০১৮ অনুযায়ী তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্সকে এই নির্দেশনার বাইরে রাখা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই স্পিড লিমিট দেশের কোনো সড়ক–মহাসড়কে অনুসরণ করা হয় না। বিশেষ করে সড়কগুলোর অবস্থা ভালো হওয়ার পাশাপাশি দেশে নতুন গাড়ির সংখ্যা বাড়ায় সড়ক–মহাসড়কে হালকা যানবাহন কিংবা বাসগুলো ৮০ কিলোমিটার স্পিডে চলে না। এসব রাস্তায় প্রাইভেট গাড়িগুলো ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি বা বেশি বেগে চলাচল করে।
স্পিড লিমিট লংঘন করলে চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করার নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ বেশি গতির গাড়িগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ‘সমঝোতা’ করায় সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন বাস কোম্পানির সাথে মাসিক ব্যবস্থা থাকায় বেপরোয়া চলাচলকারী বাসগুলোকে আটক করা না হলেও প্রাইভেটকার ও জিপসহ হালকা যানগুলোকে ধরতে পুলিশ বেশ তৎপর থাকে। গতকাল যখন কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায় পুলিশ ঢাকামুখী গাড়ির গতি নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছিলো, তখন খুব কাছেই চট্টগ্রামমুখী রাস্তা অন্তত দশ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে স্থবির হয়ে ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের সড়ক মহাসড়কে যে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ওই গতিতে গাড়ি চালানো কেবল তখনি সম্ভব যখন সকল চালকই আইন মেনে গাড়ি চালাবেন। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। তাছাড়া একই লেনে এতো রকমারি গতির গাড়ি চলাচল করে যে, গতিসীমা নির্ধারিত বেগে রাখতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সড়ক মহাসড়কের গতিসীমার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, মহাসড়ক কিংবা এঙপ্রেসওয়েতে গতিসীমা কমপক্ষে ১০০ কিমি করা উচিত। এতে যানজট কমে আসবে।
হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বহু চিন্তাভাবনা করেই গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা না মানা শুধু অপরাধই নয়, জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলা। ‘সমঝোতা’র ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, আইন লংঘন করলে মামলা করতে হবে। কাউকে ছাড় দিলে সেটাও আইনের লংঘন হবে। স্পিড লিমিট বাড়ানো বা কমানোতে পুলিশের কোনো হাত নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।