কোরআন আল্লাহ প্রদত্ত চিরসংরক্ষিত আলোকবর্তিকা ও সত্য পথের দিশা। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কালামে এরশাদ করেছেন, ‘হে আহলে কিতাবরা! তোমাদের কাছে আমার রাসূল (সাঃ) এসেছে, কিতাবের যা কিছু তোমরা এতদিন গোপন করে রেখেছিলে তার বহু কিছুই সে তোমাদের স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে, আবার অনেক কিছু সে এড়িয়ে যাচ্ছে। তোমাদের কাছে তো আল্লাহর পক্ষ থেকে আলোকবর্তিকা এবং সু’স্পষ্ট কিতাবও এসে গেছে, এর দ্বারা আল্লাহতায়ালা তাকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ বাতলে দেন। যে ব্যক্তি আনুগত্য করে তার সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, অতপর তিনি তার অনুমতিক্রমে তাদের অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন। আর তাদের তিনি সঠিক পথে পরিচালিত করেন’- সূরা আল-মায়েদা- ১৫, ১৬। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এই মহাসত্য কিতাব মানবজাতির জন্য এসেছে একটি হেদায়েত গ্রন্থ হিসাবে। এটি শুধুমাত্র পঠনের জন্য আসেনি, তিলাওয়াতের জন্য আসেনি, এসেছে আল্লাহর এই জমিনে এই কোরআনের প্রতিটি বিধান বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে। এই মহান কিতাবটি আসমানের নীচে এবং জমিনের উপর একমাত্র নির্ভুল পথপ্রদর্শক যার একটি হরফও আগামী কেয়ামত পর্যন্ত বিকৃত হবে না। ইহা সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ক, হেদায়াতের অকাট্য প্রমাণ। ‘রোজার মাস- যাতে কোরআন নাযিল করা হয়েছে। আর এটি মানবজাতির জন্য পথের দিশা। সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী’- সূরা- আল বাক্বারা- ১৮৫। এই কোরআন বিশ্ব মানবতার জন্য সার্বজনীন ও সামগ্রিক পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, যা হচ্ছে সবকিছুর ব্যাখ্যা, হেদায়াত, রহমত ও মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদস্বরূপ’- সূরা- আল-নাহল-৮৯। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, সবকিছু আমি তোমার সামনে বর্ণনা করেছি। সমস্ত জ্ঞান এবং সমস্ত বিষয় এই কুরআনুল করীমে রয়েছে। প্রত্যেক হালাল, হারাম, প্রত্যেক উপকারী বিদ্যা, সমস্ত কল্যাণ, অতীতের খবর, আগামী দিনের ঘটনাবলী, দ্বীন ও দুনিয়া, উপজীবিকা, পরকাল প্রবৃৃতি সমস্ত জরূরী আহকাম, এবং অবস্থাবলী এর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এটি হচ্ছে অন্তরের হেদায়াত, রহমত এবং সুসংবাদ। ইমাম আওযায়ী (রাঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, সুন্নতে রাসূল (সাঃ) কে মিলিয়ে এই কিতাবে সমস্ত কিছুর বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাদের কাছে রাসূল (সাঃ) কে পাঠানো হয়েছিলো তাদেরকে এবং রাসূল (সাঃ) কে আমি অবশ্যই প্রশ্ন করবো’- সূরা আরাফ- ০৬। আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমার রবের শপথ, আমি ওদের অবশ্যই প্রশ্ন করবো, সেসব বিষয়ে যা কিছু (আচরণ) তারা (কোরআনের সাথে) করেছে’ সূরা- হেজর- ৯২,৯৩। সূরা কাসাসে এই কুরআনের মাহাত্ন্য সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যিনি তোমার জন্য কোরআনকে করেছেন বিধান, তিনি তোমাকে অবশ্যই ফিরিয়ে আনবেন প্রত্যাবর্তন স্থানে’- সূরা বনী ইসরাঈলের ১২ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি সব কিছু খুলে খুলে বর্ণনা করেছি’। সূরা আনআম এর ৩৮ নং আয়াতে তিনি আরো বলেন, ‘আমি আমার গ্রন্থে বর্ণনা বিশ্লেষণে কোনো কিছুই বাদ রাখিনি’। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষের জীবন পরিবর্তনশীল, পরিবর্তীত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে মানুষকে বাঁচতে হয়। তাই তার জীবনে নিত্য নতুন সমস্যা, অভাব ও প্রয়োজন অনুভূত হয়। অন্যদিকে কোরআনুল করীম হচ্ছে শ্বাশত, স্থায়ী ও অপরিবর্তীত। এর মূল ভাষণও সীমিত। যাতে হ্রাস বৃদ্ধির কোনো অবকাশ নেই। যেহেতু অহীর ধারা রাসূল (সাঃ) ওফাত এর মাধ্যমে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে তাহলে কিভাবে ১৫০০ বছর পূর্বে অবতীর্ণ কোরআন আধুনিক জীবন সমস্যার সমাধান দিবে? এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ কোরআন হচ্ছে শব্দ ও অর্থের এক অপূর্ব সমন্বয়ক। শব্দ ও অর্থের সামগ্রিক রূপ নিয়ে কোরআন এসেছে সরাসরি আল্লাহর নিকট থেকে। এর কথামালা অতীব সীমিত এবং স্থায়ী হলেও এর ভেতরে গ্রোথিত রয়েছে এর তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা, মর্ম ও অনন্য শিক্ষার এক অনন্ত দিগন্ত। যার অতলান্ত গভীরে অবগাহন করে কোরআনপ্রেমিরা আহরণ করেন দুর্লভ জ্ঞানের আধার। আর এখানেই পাওয়া যায় কোরআনের অলৌকিকত্ব। এই কোরআন মূলত মানুষের জন্য নাযিল করা হয়েছে। তাতে তাদেরই কথা বলা হয়েছে। মানুষদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা নীতিমালা রয়েছে এই মহান কিতাবে। তাই কোরআনের সাথে তারা কেমন আচরণ করেছে সেই ব্যাপারে অচিরেই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, ‘এই কোরআন তো তোমার ও তোমার জাতির জন্য উপদেশ, তোমাদেরকে অবশ্যই এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে’- সূরা আল যুখরূফ- ৪৪। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, কোরআনুল করীম তারই ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে, কোরাইশের পরিভাষায় নাযিল হয়েছে। সুতরাং এটি প্রতীয়মান যে, এরাই সবচেয়ে বেশি কোরআন বুঝবে। তাই কোরাইশদের উচিৎ সবচেয়ে বেশি দৃঢ়তার সাথে এর উপর আমল করতে থাকা। এখানে যিকর এর অর্থ উপদেশও নেওয়া হয়েছে। এটা রাসূল (সাঃ) এর কওমের জন্য উপদেশ হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, অন্যদের জন্য এটা উপদেশ নয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তো তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি কিতাব। যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ, তবুও কি তোমরা বুঝবে না’ সূরা আম্বিয়া- ১০। মহান আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমার নিকটতম আত্নীয়বর্গদের সতর্ক করে দাও’-সূরা- আশ-শোয়ারা- ২১৪। মোদ্দা কথা-কোরআনের উপদেশ এবং নবী (সাঃ) এর রিসালাত সাধারণ। রাসূল (সাঃ) এর আত্নীয়-স্বজন, কওম এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত। এরপর ঘোষিত হচ্ছে: তোমাদেরকে অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে। তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে যে, তোমরা আল্লাহর এই কালামের উপর কি পরিমাণ আমল করেছো এবং কতখানি মেনে চলেছো? মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, ‘হে নবী আমি যেসব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে তুমি জিজ্ঞাসা করো, আমি কি দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন দেবতা স্থির করেছিলাম যার ইবাদত করা যায়? সমস্ত রাসূল নিজ নিজ উম্মতকে ঐ দাওয়াতই দিয়েছে যে দাওয়াত তুমি তোমার উম্মতকে দিচ্ছো’ এই দাওয়াতের সারমর্ম ছিল: তারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার দাওয়াত দিয়েছেন এবং অন্যের ইবাদত করা থেকে বিরত থাকার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন এবং শিরকের মূলোৎপাঠন করেছেন। যেমন: মহাপ্রশংসিত আল্লাহতায়ালা সূরা আল্ নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল (সাঃ) পাঠিয়েছি’।
লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল












