পূর্ব প্রকাশিতের পর…..
বঙ্গীয় আইন পরিষদে নেলী সেনগুপ্তা ছিলেন একজন শক্তিশালী তুখোড় বক্তা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মহিলাদের উপর বিদেশী সৈন্যদের নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে এক আবেগময়ী ভাষণে সংসদের সবাই অভিভূত হয়ে পড়েন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে এ ধরণের ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে আর না ঘটে তজ্জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৯২৮ সালের পর থেকে নেহেরু পরিবারের সঙ্গে নেলী সেনগুপ্তার সম্পর্ক গভীর হতে শুরু করে। তিনি ও তাঁর স্বামী যতীন্দ্র মোহন এলাহাবাদে গিয়ে নেহেরু পরিবারের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ইন্দিরা গান্ধীও নেলী সেনগুপ্তাকে খুব শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখতেন।
ভারত বিভাগের পর নেলী সেনগুপ্তা চট্টগ্রামে ২৪ বৎসর অবস্থান করেন। ১৯৫০ সালে নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় পূর্ব পাকিস্তান সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪-১৯৫৮ সালে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠিত সংসদ সামরিক সরকার ভেঙে দিলে নেলী সেনগুপ্তা সাধারণ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বিভিন্ন সময়ে একাত্মতা পোষণ করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের নির্যাতিত নিপীড়িত জনগণকে সহায়তায় হস্ত প্রসারিত করেন। তবে তাঁর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছিল।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন মহিয়সী নারী নেলী সেনগুপ্তা ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেত্রী। ১৯৪২-১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষকালীন সময় সাতকানিয়া, কঙবাজার প্রভৃতি দুর্গম স্থানে বার বার সাহায্যদ্রব্য নিয়ে নিরন্ন, দুঃস্থদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী তাঁর এক লিখায় লিখেছেন, “আমি মা নেলী সেনগুপ্তার মাঝে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলকে দেখেছি। ১৯৪৬ সালের বন্যায় যখন চট্টগ্রাম দক্ষিণ উত্তর অঞ্চলের বহু থানার অধিবাসীদের অপরিসীম দুঃখ কষ্ট- তখনও তাঁকে দেখেছি আর্তের সেবায় দিন নাই, রাত নাই কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন বন্যাক্লিষ্ট জনসাধারণের চরম দুর্দশা লাঘবের কাজে।
১৯৫১ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন দেশের আবহাওয়া কলুষিত, তখনও বিভিন্ন গ্রামে জনসাধারণের মনোবল ফিরিয়ে আনার কাজে তাঁকে ব্যাপৃত দেখেছি”। যেখানে নিরীহের উপর অত্যাচার, অবিচার, সেখানে তাঁকে প্রতিবাদে কঠোর হতে দেখেছি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সেবা করেছেন দুঃস্থ মানবতার। মূলত: নেলী সেনগুপ্তা একদিকে যেমন সুগৃহিনী ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন স্নেহময়ী মা। চট্টগ্রামের প্রতিটি মানুষ ছিল তাঁর আপনজন। ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চট্টগ্রামের মানুষের সেবার জন্য কোলকাতায় ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে এনে চট্টগ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দিয়েছিলেন। নেলী সেনগুপ্তা সত্যের জন্য চিরকাল সংগ্রাম করেছেন, মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন যা ছিল অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। কোলকাতায় গঠিত হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে “চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল রিলিফ কমিটি”। দুর্ভিক্ষ, ব্যনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নেলী সেনগুপ্তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণ এগিয়ে এসেছিলেন এবং হাজার হাজার দুদর্শাগ্রস্ত মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এমন মহিয়সী মাতা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত শারীরিক নানা রকম অসুবিধা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে তিনি সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। জওহরলাল নেহেরু, মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধপত্র পাঠিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিশুদের জন্য আর্থিক সহায়তা এনেছেন। নেহেরু পরিবারের শ্রদ্ধাও তিনি পেয়েছেন।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শ্রী যোগেশ চন্দ্র সিংহ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “সেনগুপ্তা তাঁহার প্রায় নিঃসঙ্গ-নিভৃত জীবনে চট্টগ্রামে সর্বদা গ্রন্থপাঠে নিরত থাকতেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সময়ে সময়ে নানা প্রকার গ্রন্থ-জীবনী, ইতিহাস, গল্প, ভ্রমণকাহিনী তাঁহাকে উপহার পাঠাতেন। আমাকেও তিনি অনেক গ্রন্থ পাঠের সুযোগ দিয়েছিলেন। গ্রন্থহীন গৃহ এবং আত্মাহীন দেহ উভয়েই সমান। অনেকে গৃহসজ্জার উপকরণ রূপে গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। কিন্তু শ্রীমতি নেলী ছিলেন উহার বিপরীত। অতিবার্ধক্য হেতু দৃষ্টি শক্তির ক্ষীণতা বশতঃ শেষ বয়সে গ্রন্থ পাঠের ব্যাঘাতের জন্য তিনি কত দুঃখ প্রকাশ করতেন”।
শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে ১৯৭০ সালের ৫ই নভেম্বর চিকিৎসার জন্য নেলী সেনগুপ্তাকে কোলকাতা নেয়া হয় যদিও বা তিনি স্বামীর ভিটা ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না। শ্রীভূপেন্দ্র নাথ দত্ত তাঁর এক অভিব্যক্তিতে উল্লেখ করেছেন, “দিগন্ত-বিসারী উত্তাল সমুদ্র আর শান্তশ্রোত কর্ণফুলী বিধৌত, চম্পক-বনরাজিশীর্ষ পর্বত শোভিত, অমর সূর্যসেনসহ অগণিত বীর শহীদ জীবন-সম্পদে সমৃদ্ধ চট্টলভূমি- স্বামী “যতীনের” জন্মভূমি চট্টলভূমি ছেড়ে নিজ জন্মভূমির নিরাপদ নির্ঝঞ্জাট জীবন অথবা আদর সম্মানের ভারতের আশ্রয় খুঁজতে একান্ত অনীহা ছিল শেষ অবধি। কিন্তু প্রকৃতি বিরূপ। শেষ জীবন তাঁর ভারতেই কাটলো। চট্টলকে, বাংলাদেশকে রক্ষিত করে সন্ন্যাসাদর্শ ভারতই গৌরবান্বিত হল এই মহিয়সী মহিলার শেষ ভস্ম গায়ে মেখে”।
ভারতের কোলকাতাতে সুচিকিৎসা, থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থার ব্যয়ভার ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীই বহন করেছিলেন। শ্রী অমলকৃষ্ণ সেনগুপ্ত তাঁর এক সুন্দর অভিব্যক্তিতে লিখেছেন, “একদিন বিদেশিনী এসেছিলেন ভারতে, জীবনের শেষ পাদে ভারতে থেকেও তিনি হলেন ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে বিদেশিনী। তারপর জীবনান্তে এই ভারতেই রেখে গেলেন তাঁর পুণ্য আশির্বাণী। মরদেহের পবিত্র অবশেষ মিশে রইল ভারতের মাটিতে। এমনই ছিল নেলী সেনগুপ্তার জীবন। কর্মে প্রেমে, ত্যাগে, বীরত্বে, কর্তব্য নিষ্ঠায়, ন্যায়ধর্মে অবিচল এক মহোত্তমা নারী। সেবায় অক্লান্ত, মমতায় মেদুর, মহত্বে মহিয়সী”
১৯৭২ সালে ভারত সরকার স্বাধীনতা-সংগ্রামী হিসেবে শ্রীমতি নেলী সেনগুপ্তাকে তাম্রপত্র দান ও পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭২ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতা গেলে মহিয়সী নারী শ্রীমতি নেলী সেনগুপ্তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তাঁর বাসভবনে যান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
১৯৭৩ সালের শেষ ভাগে নেলী সেনগুপ্তা পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পূর্বোক্ত হাসপাতালেই স্থানান্তরিত করা হয়। ইন্দিরাজীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের পরও তাঁকে আর সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৩ সালের ২৩ শে অক্টোবর রাত্রি ৩-৫০ মিনিটে এই মহিয়সী নারী ইহধাম ত্যাগ করেন। অবসান হলো এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের যাঁর ভালোবাসায় সমগ্র ভারতবাসী স্নাত হয়েছিল। বিদেশিনীর এই মহান ভালোবাসা পৃথিবীর ইতিহাসে চিরভাস্বর থেকে দেদীপ্যমান হয়ে প্রতিনিয়ত আলোচ্ছটা ছড়াবে। সমাপ্ত।
লেখক: একুশে পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, চ.বি. পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান।