মশা যেন ‘শহরের রাজা’

ঘরে-বাইরে কোথাও রক্ষা নেই ।। কী করছে চসিক, স্প্রে ম্যানের সংকট ।। ডেঙ্গু নিয়েও শঙ্কা

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৪ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

মশা যেন বাড়ির মালিক/ ভাড়াটিয়া আমরা যেন।/ কানের কাছে এসে, বলে তোরা/ দখল করে আছিস কেন?’

শহরে বেড়েছে মশার উপদ্রব। ঘরেবাইরে কোথাও রক্ষা নেই। মশার জ্বালায় সবখানেই অতিষ্ঠ থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অবস্থাটা এমনমশাই যেন ঘরের মালিক, শহরের রাজা। এ মুহূর্তের নগরের এমন বাস্তবতায় যেন ওঠে এসেছে এম এম মিজান এর কবিতা ‘মশা যেন…. কেন’। একই কবিতায় তিনি লিখেন, ‘আমরা যেন মশার প্রজা/ মশা যেন আমাদের রাজা।/ কারণে অকারণে তাইতো/ আমাদের দিতে চায় সাজা’। আসলেই কী মাত্র ২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম ওজনের ছোট্ট পতঙ্গ মশা শহরের রাজা হয়ে উঠেছে? এ মশা নিয়ন্ত্রণের কী কোনো উপায় নেই?

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এখন শহরে যে মশার উপদ্রব বেড়েছে তা ‘কিউলেক্স মশা’। তাপমাত্রা বাড়লে বৃদ্ধি পায় এ মশার উপদ্রবও। সাধারণত তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে কিউলেক্সের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। চলতি মাসে প্রায় প্রতিদিন তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ফলে প্রাকৃতিকভাবেও মশার উপদ্রব বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময় এখন।

এ ছাড়া কিউলেক্স মশা সাধারণত দূষিত পানিতে জন্মায়। এদিকে শহরের নালানর্দমাগুলো ময়লাআবর্জনায় ভরে আছে। যা কিউলেক্স মশা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। শহরের প্রধান খালগুলো ছাড়াও সেকেন্ডারি ড্রেনগুলোও আবর্জনায় পূর্ণ। যা কিউলেক্স মশার লার্ভা বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। খালনালাগুলো ভরাট থাকায় বন্ধ আছে স্বাভাবিক পানি প্রবাহও। অথচ পানি প্রবাহ ঠিক থাকলে খাল হয়ে মশার লার্ভা চলে যায় নদী বা সমুদ্রে। অর্থাৎ তাপমাত্রাজনিত কারণে প্রাকৃতিকভাবে মশার বংশ বিস্তার যেমন হচ্ছে তেমনি মনুষ্য সৃষ্ট কারণেও খালনালা বন্ধ থাকায় বাড়ছে মশার উপদ্রব।

কী করছে চসিক : ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিল এর এক নং অনুচ্ছেদে ‘জনস্বাস্থ্য’ বিষয়ে যে ক্ষমতা তার আলোকেই মশক নিধনে ব্যবস্থা নিতে হবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক)। অর্থাৎ নগরে মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব চসিকের। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, মশার উপদ্রব বাড়লেও কী করছে চসিক? সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্র্মকর্তারা দাবি করছেন, মশক নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। তবে নগরবাসী বলছেন, কীটনাশক ছিটাতে তারা দেখছেন না। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভও আছে নগরবাসীর।

সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পেজএর বিভিন্ন পোস্টে কমেন্ট করে মশা নিয়ে বিরক্ত নগরবাসী তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন। যেমন গত রাতে একটি পোস্টে আবদুল আজিজ নামে একজন কমেন্ট করেন, ‘মশা থেকে কবে মুক্তি পাব?’ ফেরদৌস আহমেদ নামে একজন কমেন্ট করেন, ‘মশা, মশা, মশার জ্বালায় অস্থির। হালিশহর এরিয়ায় কার্যকর মশার স্প্রে দিন।’ স্প্রে ম্যানরা টাকার বিনিময়ে কেবল প্রভাবশালীদের বাড়ির আঙিনায় ওষুধ ছিটায় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সাইদুল ইসলাম সাইদ কমেন্ট করেন, ‘সারা শহরকে বাঁচান। মশা নিধন করুন। নয়তো কয়দিন পর মানুষ ডেঙ্গু সামাল দিতে পারবে না’।

এদিকে জানা গেছে, মশা নিয়ন্ত্রণে দুই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করে চসিক। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসে ‘এডাল্টিসাইড’ এবং মশার লার্ভা মারতে ব্যবহার করে ‘লার্ভিসাইড’। এর মধ্যে কিছুদিন সংকট ছিল এডাল্টিসাইডের। গত পরশু সাড়ে ৫ হাজার লিটার এডাল্টিসাইড সংগ্রহ করা হয়। ফলে এখন আবার মশক নিধন কার্যকম জোরদার করা হবে।

এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার চসিকের বর্তমান পর্ষদের ৩৮তম সাধারণ সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও মশা দ্রুত বাড়ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে স্প্রেম্যান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট লোকবল বাড়িয়ে মশা নিধনে প্রতিটি ওয়ার্ডে আরো ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতিরোধে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কাউন্সিলরদের মাঠে থেকে তদারকি করতে হবে এ কার্যক্রম।

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমী আজাদীকে বলেন, হঠাৎ মশার উপদ্রব একটু বেড়েছে। তবে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। মশক নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। মাঝখানে এডাল্টিসাইডের কিছুটা সংকট থাকলেও আবার সংগ্রহ করেছি। এখন পর্যাপ্ত ওষুধ আছে।

চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী আজাদীকে বলেন, বৃহস্পতিবার প্রতি ওয়ার্ডে ৩০ থেকে ৫০ লিটার করে অতিরিক্ত এডাল্টিসাইড দেয়া হয়েছে। সাথে মাসকুবার দেয়া হয়েছে। প্রতি লিটার এডাল্টিসাইডের সাথে ১০ মিলিলিটার মাসকুবর মিক্স করে ছিটানো হচ্ছে। এতে বেশ উপকার হচ্ছে।

সংকট স্প্রে ম্যানের : অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, চসিকে স্প্রে ম্যানের পদে জনবল আছে হাতেগোনা। তাই ডোর টু ডোর প্রকল্প ও নর্দমার ১৬৪ জন শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্প্রে ম্যান বা মশক নিধন কর্মী হিসেবে কাজে লাগায় চসিক। এসব স্প্রে ম্যানকে কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে ভাগ করে দেয়া হয়। তবে এসব স্প্রে ম্যানকে কীটনাশক ছিটানোর পরিবর্তে অন্য কাজ করানোর অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কয়েকদিন আগে একটি অফিস আদেশও জারি করেন। এতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন ওয়ার্ডে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মশার ওষুধ স্প্রে ও ফগিং কাজে নিয়োজিত সেবকদেরকে স্বীয় কাজ থেকে বিরত রেখে আবর্জনাবাহী গাড়ি, নালা পরিস্কার করানো, ঝাড়ু দেয়া ইত্যাদি কাজ করানো হচ্ছে। ফলে নিয়মিত মশক নিধন কাজে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। যা মোটেই কাম্য নয়।’

অফিস আদেশে এটাও বলা হয়, নিরবচ্ছিন্ন মশক নিধন কাজ চলমান বজায় রাখার স্বার্থে প্রতিটি ওয়ার্ডে স্প্রেম্যানদেরকে দিয়ে কেবল মাত্র স্প্রে কাজ এবং ফগা মেশিন চালকদের দিয়ে ফগিং করানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে বেতন কর্তন অথবা অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।

শঙ্কা ডেঙ্গু নিয়ে : কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজননকাল। আবার কিউলেক্স মশার জন্ম হয় শুষ্ক মৌসুমে। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এর প্রকোপ থাকে। তাই সারা বছরই মশক নিধন কার্যক্রম চালানো উচিত। তবে মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই মশক নিধন কার্যক্রমে কোনোভাবে অবহেলার সুযোগ নেই।

২৮ মার্চ প্রকাশিত সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১২২ জন ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। এ সময় মারা গেছেন ৩ জন।

চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওছ আজাদীকে বলেন, বর্তমানে তাপমাত্রা একটু বেড়েছে তাই মশার উপদ্রবও বেড়েছে। সাধারণত ২৮ ডিগ্রি প্লাসমাইনাস বেশি তাপমাত্রা হলে মশার উপদ্রব বাড়ে। এখন তো তাপমাত্রা আরো বেশিই। তবে এখন যে মশার উপদ্রব সেটা হচ্ছে কিউলেক্স মশা। সামনে বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপদ্রব বাড়বে। তাই সিটি কর্পোরেশনকে এখন থেকে সতর্ক হতে হবে। বৃষ্টি শুরু হলে, নালানর্দমায় পানি চলাচল করলে কিউলেক্স মশা কমে যাবে। কিন্তু তখন বৃষ্টির জমে থাকা পানির জন্য এডিস মশা বাড়বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধকাপ্তাইয়ে আনসার ব্যারাকে বন্যহাতির তাণ্ডব