মরমী সাধক শীতালং শাহ: জীবন, দর্শন ও গান

ইকবাল হায়দার, সংগীতশিল্পী | বুধবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:৫৬ পূর্বাহ্ণ

সংগীত কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে মনপ্রাণ আকুল করে, চিত্ত উদ্বেলিত করে। এ কারণে শাস্ত্রীয় কঠোর শাসন প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা সংগীতকে পরিহার করতে পারেনি। সুফি ধর্মের বিভিন্ন মরমী সমপ্রদায় সামা, হালকা ও দারা সাধনার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। তাই পাকভারতবাংলায়মুসলিম সমাজে সংগীত চর্চা যে সুফী প্রভাবের ফলনিঃসন্দেহে তা বলা যায়।

বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু অত্যধিক ভাবপ্রবণ তাই তাদের কণ্ঠে গান এসেছে এই ভাবপ্রবণতা থেকেই। গানের দেশ বাংলাদেশ। বঙ্গভূমি সংগীতের রঙ্গভূমি, বাঙালির মুখে গান, হাতে কাজ এই ঐতিহ্য নিয়ে সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলার লোকসংগীত সগৌরবে হয়ে আজো বেঁচে আছে।

মহাত্মা গান্ধী তাই বলেছেন, আমি যদি গান শুনতে চাই তাহলে আমাকে যেতে হবে বাংলায়। সে দেশে গায়ক আছে তাদের অতিক্রম করা শক্ত। (নীল রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্তানি সংগীতে বাঙালির অবদান, দৈনিক বসুমতী, শারদীয় সংখ্যা,১৩৯১ সাল, পৃ,৩১৫ থেকে উদৃত)

বাংলার লোকসংগীতের সম্বৃদ্ধ ঐতিহ্যে আকৃষ্ট হয়ে মুগ্ধ চিত্তে মহাত্মা গান্ধী এ উক্তি করেছিলেন। বাঙালির লোকসংগীত সাধনার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় চেতনা ও আবেগ, রয়েছে সাহিত্য, রসাস্বাদন প্রবণতা, আরো রয়েছে দার্শনিকতাপূর্ণ মরমীবাদের তত্ত্ব চিন্তার খোরাক। পৃথিবীর সকল জাতির মতো বাঙালির সাহিত্য সাধনার জয়যাত্রাও শুরু হয় সংগীত রচনার মধ্য দিয়ে। তত্ত্ব দর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধনা এর প্রাণ প্রবাহিনী শক্তি। এই ঐতিহ্য নিয়ে বাংলার লোকসংগীত সগৌরবে আজো বেঁচে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বাংলার লোকসংগীতের সাধারণ আটপৌরে গান থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ গানে রয়েছে এই গৌরবময় ঐতিহ্য ও সুর। বাংলার ধুয়া, ভাব, মুর্শিদীমারফতি, জারী সারি, বাউলবৈষ্ণব, ভাওয়াইয়াভাটিয়ালি, মাইজভাণ্ডারি প্রভৃতি জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক সংগীতের মত সিলেটের জনপ্রিয় সাধক শীতালং শাহর গানও জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক সংগীত হিসেবে বিবেচিত। তাঁর রচিত মারফতিবা মুর্শিদীগানগুলিতে গভীর আধ্যাত্মভাব বিধৃত হয়েছে। শীতালং শাহের মারফতি ও মুর্শিদী গানের সুর করুণ। সুফির আর্তির মধ্যেও চিরন্তন কান্নার সুর আছে। পবিত্র প্রেমের আশেক মাশেকের বিরহ ভাবনা ও চিরন্তন কান্নার সুর শীতালং শাহের গান কে সকল প্রকার পংকিলতা ও অধঃপতন থেকে রক্ষা করেছে।

শীতালং শাহর আসল নাম মোহাম্মদ সলিমউল্লাহ। কেহ বলেন মুনশী মোহাম্মদ সলিমউল্লাহ।

তিনি বৃটিশ ভারতের সাবেক সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর থানার শ্রীগৌরী পরগনার শীলচরগ্রামে ১২০৭ বাংলা (মতান্তরে কারণ সলিমউল্লাহ কোথাও জন্ম তারিখ উল্লেখ করেন নি) ১৮০০ ইং সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জাঁহান আলী বক্স এবং মাতার নাম সুরত জান বিবি।

তাঁর লেখপড়া শুরু হয় তারিনীপুর মক্তবে। পরে ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় ভর্তি হন।

মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্ত হলে তিনি অনেক দিন তাঁর মুর্শিদ শাহ আব্দুল ওহাব সাহেবের খেদমতে অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর মুর্শিদ তাঁকে ‘শীতালং’ (পায়ের গোড়ালি উপাধি দেন। এটি একটি ফারসী শব্দ। তার পরবর্তীতে তাঁকে নির্জনে সাধনার পরামর্শ দেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাহিত্য শুধু তত্রস্থ মার্জিত রুচিসম্পন্ন শিক্ষিত জ্ঞানী, গুণীব্যক্তি বর্গের লেখনি নিঃসৃত ভাবধারায় পুষ্ট নয়, সে সব দেশের পল্লীর অজ্ঞাত, অখ্যাত, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দ শ্রদ্ধা ও গভীর নিষ্ঠার সাথে সাহিত্য সেবা করে সাহিত্যের পরিপুষ্ট সাধন করেছেন।

আমাদের বাংলা সাহিত্য শুধু হেমচন্দ্র, নবীনচেন্দ্র,বঙ্কিম, মধুসূদন, বিহারীলাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম দ্বারা পরিপুষ্ট নয়। সে সাহিত্য বাংলার পল্লীর অজ্ঞাত, অখ্যাত কবিদের সাধনার বিরাট মহীরুহরূপে সৃষ্টি হয়েছে। এই সুদূর সিলেট জেলায় গ্রামাঞ্চলে অবস্থান করেও সাধক কবি শীতালং শাহ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনবদ্য কাব্য রচনা করে গেছেন।

মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালে তিনি আধ্যাত্মিক বিদ্যায় পারদর্শী কতিপয় শিক্ষকের সংস্পর্শে আসেন। এদের সংস্পর্শে ও ছহবতে মোহাম্মদ ছলিম উল্লাহ আকৃষ্ট হন ইলমে মারিফতের দিকে।

মাদ্রাসার অধ্যয়ন শেষ করে শাহ শীতালং শাহ বাণপ্রস্থ অবলম্বন করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর সংসারের প্রতি বিরাগভাব পরিলিক্ষত হয়। তিনি দীর্ঘ বার বছর গুরুর পরামর্শে লাউড় ও ভুবন পাহাড়ে আল্লাহর আরাধনায় নিরত থাকেন। কত যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত তার উপর দিয়ে অতিবাঘিু হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই, যুগব্যাপী কৃচ্ছ সাধনায় নিমগ্ন থাকার পর তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন।

তিনি শরিয়তের পূর্ণ পাবন্দ ছিলেন, তাঁর রচনা এবং জীবনের চলার পথে তা পূর্ণ ভাবে প্রমাণিত। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল ইসলামী কানুন মত। তাঁর রচনায় বহুবার রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার উল্লেখ দেখা যায়। তাতে বোঝা যায় রাধার বিরহ অনলের ও প্রেম নিবেদনের এবং ভাবাবেগে রূপকের অন্তরালে যে নিগূঢ় গভীর আধ্যাত্মিকতা রয়েছে তা সাধক কবি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁর অল্প বয়সে ফুলবাড়িতে ছাত্রাবস্থায় সেখানকার খুব গোঁড়া ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবেশে রূপকের মোহজাল ভঙ্গ করে বৈষ্ণব ভাবাবেগের একেবারে অন্তরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা সেখানে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই বা তাঁর গ্রাম তারিণীপুরে তো তা অকল্পনীয়। অথচ কবির রচনায় তা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি সাধনায় এমন সব প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন যে সব হিন্দু যোগীগণঅবলম্বন করে থাকেন। তা ছাড়া তিনি হিন্দু সাধকদের মত কোন কোন সময় নিজেকে নারীরূপে কল্পনা করে আল্লাহকে নবরূপে কল্পনা করেছেন আবার অন্য সময়

নিজেকে রাধিকারূপে কল্পনা করে আল্লাহকে কৃষ্ণ রূপে ভেবেছেন

প্রেম রসে প্রেম সিন্ধু সান্তারে করে লংঘন

মদন তরংগে ভাসি দিবে আসি দরশন।

প্রেমানলে উদাসিনী প্রিয় বিনে দহে মন

বিচ্ছেদের তীক্ষ্ম শরে দেহা জ্বলে অনেক্ষণ’

আর

শীতালং এ কহে প্রাণেতে না সহে

বিরহেতে সন্ন্যাসিনী পন্থ হারা হইয়া

ডাকি প্রিয়া প্রিয়া

আইস প্রিয়া গুণমনি গো অধিতি রাই’

তিনি ফকির হয়েও গৃহী ছিলেন, সংসারী ছিলেন, শরিয়তের অত্যন্ত বেশি অনুগত ছিলেন, সালিক ছিলেন, সন্ন্যাসী ছিলেন না। তিনি এই উপলব্ধি করে ছিলেন যে শরীয়তের বরখেলাপ করে মারিফত লাভ হয় না। যে পিয়াস তাঁর প্রাণে সৃষ্টি হয়েছিল তা শুধু নামাজ রোজাতে তৃপ্তি এনে দিতে পারত না তাঁর চাওয়া ছিল আরো উচ্চ স্থরের আল্লাহর কুদরত ও দিদার।

সংসারে প্রবেশ করে শীতালং সংগীত রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠার গানের বই রেখে গেছেন সিলেটি নাগরী হরফে। তাঁর গান সমূহ মূশকিল তরান‘ ‘কেয়ামত নামারাগ বাউলাএই তিন খণ্ডে বিভক্ত।

আল্লাহর প্রেমে পাগল সাধক শীতালং শাহ দুঃখ করে বলেছিলেন, নামাজ পড়েও তাঁর মন মজল না, তিনি চাহেন আল্লাহর প্রেম, শুধু নামাজে তাঁর নিদারুণ পিয়াসা মিটল না।

শীতালং শাহ একজন উচ্চাংগীয় সাধক ছিলেন।

শীতালং শাহভাবের মানুষ। মানুষের প্রেমকে ঈশ্বরের প্রেমে রূপায়িত করাই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। প্রেমের দেবালয়ে পৌঁছানোর একটি মাত্র পথ হল সমর্পণ বা সারেন্ডার। সব কিছু ঈশ্বরের কাছে সঁপে দেওয়া, সব কিছুকে ঈশ্বরের দান বলে মেনে নেওয়ার মধ্যেই জীবনের আনন্দ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি ধ্যানে, জ্ঞানে অন্তরের অন্তঃস্থল দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, তার আমিত্বতার নয়। দুদিনের পান্থশালায় মানবজীবনের দোষ গুণ, ভালো মন্দ, পাপ পুণ্য, সফলতা, ব্যর্থতা সব কিছু ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের মহাজীবনের মহানন্দের স্বাদ খুঁজে পেয়েছিলেন শীতালং শাহ।

নাইটেংগলের গান যেমন কীটস কে এক স্বপ্নময় রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিল, স্কাইলার্কের গান যেরূপ শেলীকে পৃথিবী থেকে নিয়ে গিয়েছিল সীমাহীন উদার নীলিমায়, ঠিক তেমনি মহাসৃষ্টির বিরাট রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটন করতে গিয়ে শীতালং শাহ সৃষ্টি করেছেন অজস্র গীত আর সুর। যে সুরের আনন্দে নিজে হয়েছেন আত্মহারা আর অন্যকে করেছেন পাগল পারা।

এ বরাক উপত্যকার সাধক কবি শীতালং শাসুয়া পংখী খাঁচা ছেড়ে মিশে যেতে চাইছিল মহাসৃষ্টির মহান স্রষ্টার সাথে,

সুয়া উড়িল উড়িল জীবের জীবন

সুয়া উড়িল রে।

আর লা মোকামে ছিলায় সুয়া

আনন্দিত মন

পিঞ্জিরায় থাকিয়া কইলাই প্রেমেরসাধন

এগো ছাড়িয়া যাইতে কিন্তু না লাগে বেদন।

সুফী সাধক শীতালং শাহ ছিলেন স্বভাব কবি ও মৌলানা। তিনি ওয়াজ নসিহত, ইসলামী আহকামআরকান সবই গানের মাধ্যমে বয়ান করতেন। তাঁর গীত গানগুলিকে শীতালংগী রাগবলা হয়ে থাকে। তৎকালে করিমগঞ্জ অঞ্চল ছিল সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্ম ও ইসলামী সুফী ধর্মের প্রভাবিত অঞ্চল। সুফী ধর্ম ও সাধনা একান্তভাবে মর্ম মুখী, সাধকের ব্যক্তিগণ এই ধর্ম ও সাধনার একটি বিশিষ্ট দিক বলে একে অতীন্দ্রিয় বাদ বা মরমিয়া বাদ বলে অভিহিত করা হয়।

সুফী সাধনাতে মানবদেহকে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। মানুষই বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডের সার সংক্ষেপ বা ইহার প্রতিরূপ। সুফীগণ বিশ্বাস করেন, অজড়শক্তি হল কলব, রূহ, সিরআধ্যাত্মিক জ্ঞান, আর খাফি হল উপলব্ধি শক্তি, আখফ্‌ হল অনুভূতির শক্তি, জড় হল আব, আতস, খাগ, বাত, নফস। জগতের প্রতিরূপ এ মানুষের মধ্যেই স্রষ্টা আবির্ভূত হতে পারেন।

জীবাত্মা পরমাত্মার সাধনাই তাদের কাজ।

মরমী সাধক কবি শীতালং শাহ আল্লাহ কে অনির্বচনীয় রহস্যময় জেনে সে অদৃশ্যকে সামনে রেখে সাধনা করে সালিক হতে তরীকতে পৌঁছে ছিলেন।

প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য, অজানাকে জানার জন্য তাঁর কী করুন কাকুতি মিনতি। মানুষের অজুত অর্থৎ শরীরের গূঢ় রহস্য সম্পর্কে তিনি বলেন,

বাহান্ন বাজার তেপান্ন গলি আদমের অজুতে

কৌশল করিয়া পয়দা করিছে মাবুদে

তাঁর মতে যারা প্রেমিক পথিক, তাদের চলন, বলন আচার, ব্যবহার, অদ্ভুত ও আচানক। সাধারণ মানুষের সংগে তার মিল নেই। তাই তিনি বলেন,

পিরিতের ছলে বুকে যার

কলংক তার অলংকার

কুল মানের ভয় নাইরে তার।

পার্থিব জগতের অসারতা ও পরকালের মূলধন সঞ্চয়ের তাগিদে তিনি অনেক বাউল গান লিখেছেন।

সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী এ গানের প্রথম দুটি লাইন তারই রচনা ( এখনো অনেক শিল্পী, কবি, গীতিকার, লেখকের কাছে অজ্ঞাত। এ দুটি লাইন সংগ্রহ বলে বিদিত)

অদৃশ্যকে দৃশ্যে আনার, অরূপকে রূপে উপলব্ধির ক্ষীণ হলেও একটি সূক্ষ্ম অনুভূতি তার অনেক গানে জেগে ওঠে। মৃত্যু ও পরকালের চিন্তা তাঁকে স্বভাবিক ভাবেই পীড়িত করে।

নাছুত, মালাকুত, জবরুত ও লাহুত এই চার মোকামের সাধন পন্থাকে যথাক্রমে শরীয়ত, তরীকত, হকীকত ও মারিফাত বলা হয়। শীতালং শাহের গানে সেই পরিচয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে,

ভবের বাজারে আছে দুকান সারি সারি

জাতে জাতে ধন লইয়া বসিছে পশারি।

বাজারের চারি দুকান সবার প্রধান

এ চারি দুকানে মিলে মাল বদখশান।

পরথম দুকানে রাজপন্থ খোলা

যে দুকানে লাগিয়াছে শরিয়তের তালা।

দ্বিতীয় দুকানে যেই করিয়াছে ছন্দি

জগত ছত্রআলে যথ সেই দুকানে বন্দী।

সেই দুকানে হইবে জগণ উজালা

সে দুকানে লাগিয়াছে তরীকতের তালা

তিরতীয় দুকানে আছে আতসের চুলা

সে দুকানে লাগিয়াছে হকিকতের তালা

চতুরথ দুকানে বন্ধ আমানু পুনজি

সে দুকানে লাগিয়াছে মারিফাতের কুনজি

শীতালং ফকিরে বলে হইয়া উদাস

খোলা না পাইলাম কুঞ্জ না পুরিল আশ

শীতালং শাহ একজন সাধক গীতিকার হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তার মধ্যে যে একটি সরস, সংবেদনশীল ও সজীব কবি প্রাণ ছিল এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।

শীতালং শাহ র মারফতি গানে দেঘুত্ত্ব রূপায়িত হয়েছে। মানব দেহের প্রতিটি অংগ প্রত্যংগের গঠনতত্ত্ব এবং পবিত্র কোরআন শরীফ রচনার উৎস আরবী ত্রিশ হরফ থেকে এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা তাঁর রচিত একটি মারফতি গানের ধুয়ায় পাওয়া যায়

ত্রিশ হরফে কোরান শরীফ

রচিয়াছে সাঁই

তিন হরফে আদম ছবি

রাখিয়াছে বানাই।

কবি মানব দেহের মুখমণ্ডল থেকে শুরু করে পদুল পর্যন্ত প্রতিটি অংগের গঠন রহস্য বর্ণনা করেছেন।

মানুষের দেহরূপ নৌকা এবং এই দেহঘরী পার্থিব জগতের ঘাটে ঘাটে ঘুরে ফিরে অবশেষে কীভাবে মূল লক্ষে যাত্রা করে তার নিখুঁত বর্ণনা করেছেন গানে। দেহতত্ত্বের সংগে তিনি মৃত্তিকাতত্ত্বের ব্যাখ্যাও করেছেন।

সুফী প্রেমে পাগল কবি শীতালং শাহ অনুভব করেন যে জীবাত্মা পরমাত্মারই একটি ক্ষুদ্র অংশপৃথিবীতে জীবলীলা শেষে তা পরমাত্মার নিকট ফিরে যাবেই।

আবার শীতালং শাহ’র গানে নৈষ্টিক বৈষ্ণব কবির মু বৃন্দাবন, মথুরা, যমুনার ঘাট, কলসী, গোকুল, ব্রজধারা, জলকিড়িলা, কৃষ্ণ, বৃষভানু, ললিতা, ব্রজধাম, কাশী, মোহনমুরলী, গোকুল, কদম্বতলা, প্রভৃতি স্থানব্যক্তি, চরিত্র আছে, এবং কবি যেভাবে রাধাকৃষ্ণের চরণে আপন অন্তরের আকুতি নিবেদন করেছেন তাতে তাঁকে বৈষ্ণব কবি ভিন্ন অন্য কিছু মনে হয় না। অথচ কবি একজন মুসলমান সুফি সাধক। তা সত্ত্বেও তাঁর অনেক গানে বৈষ্ণব কবিতার আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে অত্যন্ত চমৎকারভাবে।

শীতালং শাহ র একটি পদ স্পষ্টই রাধাকৃষ্ণ রূপক এবং আধ্যাত্মিক ভাবপূর্ণ। তিনি এখানে পার্থিব জগতের জীবাত্মার প্রতীক কাশিবৃন্দাবনবাসিনী রাধা, আধ্যাত্মিক জগতের পরমাত্মার প্রতীক কৃষ্ণ, যিনি

ব্রজপুর রাজ্যে মথুরা নগরে আছেন তার সংগে মিলিত হবার জন্য আর্তি ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু মধ্যে ভীষণ তরংগ বিক্ষুব্ধ ভবনদী, দুর্যোগপূর্ণ ঘোর অন্ধকার রজনীতে কৃষ্ণ প্রেম বিরহিনী দরশনের নৌকায় ভেসে এই ভব সিন্ধু পার হতে চান। কবি নিজ অন্তরে রাধাভাবঅনুভব করে কৃষ্ণ প্রেম পাওয়ার জন্য পদটির শেষে গেয়েছেন

শীতালং ফকিরে কহে

বিরহের জ্বালা

কোথায় রৈলায় চিকন কালা

দুষ ক্ষমিয়া সুদর্শনে

দান দেও প্রাণ রব্বানি

তাঁর অনেক লেখায় কৃষ্ণ লীলা কাহিনি আধ্যাত্মিক ও লৌকিক ব্যঞ্জনায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে

জলে নি যাইবার সখি গো

চলো প্রাণেশ্বরী

যমুনার ঘাটে

বাজে মোহন মুরলী।।

অন্যখানে,

শীতালং ফকিরে কয়

ভবেতে আসিয়া

কলসী নি হইলে ভরা

না ভজিলাম প্রিয়া

আর একটি গানে রাধা গোপীগণপরিববৃতা হয়ে শ্যামের বাঁশী শুনে যমুনায় যায়

আগে পাছে সব ধনি

মধ্যে রাধা চন্দ্রমণিরে

ওরে ঘাটে গিয়া পুলিনে দাঁড়ায়।

অন্য গানে,

শীতালং ফকিরে বলে

বন্ধু বিনে দেহ জ্বলেরে

ওরে, প্রাণ জুড়ে তার প্রেমদায়।

আসলে পরম সত্তার দরশন পাবার জন্য রাধার অন্তরে কৃষ্ণ প্রেম অনুভব করেন। তার অন্তরের আকুল আবেদন

শীতালং ফকিরে কয়

শ্যামরে কালিয়া

প্রকাশিত কর ঘর

দরশন দিয়া

সবার পরে দেহরূপ ঘরের মধ্যে পরমারাধ্য চিকন কালারবসতি। তার দুয়ারে আবার কাল ভুজংগিনী। অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত মানব দেহে রয়েছে আটশ চল্লিশ টুঠুরী। সেখানে চিকন কালার অপরূপ লীলা চলে নি তাই কবি বলেছেন,

ঘরের মধ্যেতে ঘর অতি মনোহর

আটশ চল্লিশ তাতে কুঠরি সুন্দর।

অপূর্ব কাহিনী ঘর অপরূপ লীলা

ভুজংগিনী দুয়ারেতে ঘরে চিকন কালা।

ইসলামে সংগীতকে উৎসাহিত করা হয়নি। অথচ বিস্মিত হতে হয় যখন দেখি শীতালং শাহের মত একজন খাঁটি মুসলমান যিনি মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করছেন তিনিও গান বাজনার ভক্ত। এমনকি তাঁর রচনায় বৈষ্ণব ভাবের প্রকাশ সুস্পষ্ট। বহু গানে তিনি রাই, রজনী, সখী, শ্যাম চণ্ডী, ত্রিপূর্ণি প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন।

তাঁর গানে দৃষ্ট হয় ইসলাম ধর্মে বর্ণিত মানুষ সৃষ্টির তত্ত্ব, রসুলের প্রশংসা, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা এবং ইসলাম ধর্ম সম্মত আচার, আচরণ বিষয়। আবার সুফী তত্ত্বাশ্রয়ী এবং বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত তত্ত্বও দৃষ্ট হয়।

শীতালং শাহ র সংগীত গুলোর ভাষা ও উপজীব্যে যে দুটো ব্যাপার অভিব্যক্ত, সে গুলোই আমাদের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিক চেতনার মূল দ্যোতক।

প্রথমতঃ শীতালং শাহের তিরোভাব ঘটেছে ১৮৯৯ সালে সুতরাং তার সংগীত রচনাকাল উনবিংশ শতাব্দী। সে কালে তার সংগীতাবলীতে যে সকল শব্দ তিনি চয়ন করেছেন তা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষারই উনবিংশ শতাব্দীর রূপ বিশিষ্ট। শীতালং শাহ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষিত, আরবী পার্শি ভাষার বুৎপত্তি সম্পন্ন ধর্মশাস্ত্রবিদ। বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করার কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। কাজেই তাঁর শব্দ চয়নের দক্ষতা দৃশ্যে তৎকালীন সুরমা উপত্যকার মুসলমান সমাজে বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চার ব্যাপকত্ব অনুধাবন করা যায়।

দ্বিতীয়তঃ ইসলামী ভাবধারা বৈষ্ণবীয় প্রকাশ ভংগীতে বিবৃত করে শীতালং শাহ দেখিয়ে দিয়েছেন কী সহজভাবে দুই বিপরীত উৎসমুখী সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানো সম্ভব।

আজ আমরা ইংরেজী, ফরাসি, রুশ প্রভৃতি বিদেশী ভাষা তথা সাহিত্য সাহিত্যিকদের জীবনী রচনা ইত্যাদি সংগ্রহে ব্যস্ত। বিদেশী পপ সংগীত, রক, ব্লুজ, ডিসকো ইত্যাদি সংগীত নিয়ে মত্ত। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের ঘরের অন্ধকার কোণে যে সাধক শ্রেষ্ঠ শীতালং শাহ প্রমুখ পল্লী কবিদের গান, যেগুলি নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের লোক সাহিত্য ও সংগীতের অমূল্য রত্ন, সেগুলি আমাদের ঔদাসীন্য ও উন্নাসিকতায় অবহেলায় যেন ধূলি মলিন হয়ে না যায়।

আধ্যাত্মিক জ্ঞান পার্থিব জীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। আর এ জন্যই যুগে যুগে বহু সাধক মানুষের জন্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণ করে গেছেন যার সান্নিধ্যে ও আশ্রয়ে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে পবিত্র ও সুন্দর, পথ চলা হয়েছে সহজ ও সাবলীল।

সাধক কবি ফকির শীতালং শাহ এমনি এক মরমী হৃদয়। যিনি জীবন ও জগতকে তাঁর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে রচিত হয়েছে তার হৃদয় নিঙড়ানো মরমী গান।

আমরা আগেই জেনেছি শাহ সুফী শীতালং শাহের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ সলিমউল্লাহ। শীতালং তার ফকিরী নাম। তিনি কঠোর সাধনার মাধ্যমে ইলমে মারেফাতের উচ্চতর মোকামে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন, খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের পরম পথের পরিসমাপ্তি। অবশেষে, বাংলা ১২৯৬ সনের ১৭ অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৮৯৯ সালে মন আর মগজ একই বিন্দুতে এসে বৃত্তপরিভ্রমণের যবনিকা টানলেন।

তথ্য পঞ্জী

১। মরমী কবি শীতালং শাহ, সংকলন ও সম্পাদনানন্দলাল শর্মা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

২। সাধক শীতালং, নুরুল ইসলাম, ইশারা ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, সিলেট ১৩৬৩।

৩। মরমী সাধক শীতালং শাহ, মাহবুব বারী, মরমী কবি শীতালং শাহ, সম্পাদকনন্দলাল শর্মা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

৪। হিন্দুস্তানি সংগীতে বাঙালির অবদান, নীল রতন বন্দ্যোপাধ্যায়, দৈনিক বসুমুী, শারদীয় সংখ্যা, ১৩৯১ সাল, পৃ,৩১৫।

৫। লোকসাহিত্য সংকলন, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৩৭০ সম্পাদকীয়, পৃ, ৩।

৬। বাংলার মুসলমান বৈষ্ণব কবিপ্রবন্ধ, বিশ্বভারতী, মাঘ চৈত্র,

৭। ড, গোলাম সাকলায়েন, বাংলাদেশের সুফী সাধক, বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৭ সাল, পৃ,৬৫।

লেখক : সংগীতশিল্পী, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তি : বইয়ের বন্ধু নাকি ঘাতক?
পরবর্তী নিবন্ধসংবাদপত্রকে ভালোবেসে যিনি দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন