মানুষের জীবন হচ্ছে এক বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ–অতীত থেকে বর্তমান ছুঁয়ে অবশেষে মহাকাশের পথ। এরই মাঝে ঘটে যায় কত কিছু আশা–হতাশা–বেদনা–স্বপ্ন আবার স্বপ্ন– ভঙ্গের কষ্ট। তাই তো কবি মমতাজ সবুর লেখেন–
‘আশার প্রাণের গভীরে
কেন যে এত কষ্ট বুঝি না– আশার কষ্টের ক্ষত চুঁইয়ে
কেন যে এত রক্ত ঝরে আমি জানি না।’
আমরা– এ দেশের মেয়েদের অনেকে অনেক কিছুই পারেন, কিন্তু অনেকেরই অনেক কিছু হয়ে ওঠে না। মনের ভেতরে এক স্ফুলিঙ্গ নিয়ে জমলেও অবশেষে তা জ্বলে ওঠে না। ক্রমশ নিভৃতেই থাকে। পঞ্চাশ দশকেরও আগে একদা যে মেয়েটি স্কুলজীবনে প্রগতিশীল দলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন অথবা বিদ্রোহী মনোভাবে বলেছিলেন ‘আমি সংসারী হবো না’ অথচ মাত্র পনের বছর বয়সে ভেতরের অমিত সম্ভাবনার প্রতিভা নিয়েও উটপাখির মতো মুখ থুবড়ে পড়তে হল সংসারেই– মমতাজ সবুরের কৈশোর জীবনেই সৃজনশীল মনের বিকাশ ঘটেছিল, সে সময়েই লিখতেন ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং রেডিওতে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েও যেতে পারলেন না পারিবারিক বাধার কারণে।
লেখালেখির সুবাদে খ্যাতিমান কবি গোলাম মোস্তফার সাথে সাহিত্যিক সখ্যতাও গড়ে ওঠেছিল অথচ প্রস্ফুটিত ফুলের পাপড়িতে বিকশিত হওয়ার আগেই সাংসারিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে অবশেষে অপরিমেয় কষ্টের সাথে জীবন সংগ্রামের সৈনিক হয়ে যুদ্ধ শুরু হল জীবনেরই সাথে। মাতৃত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিপূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও যৎসামান্য শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সংসারের বোঝাও টানতে হল তাঁকে।
উনার কথাতেই ‘লেখালেখির জগৎটা অনেক কষ্টে মোটামুটি ধরে রেখেছিলাম’। আর এই অঙ্গনে মমতাজ সবুরের পদচারণা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। আবারো তাঁর কথাতেই– কাজের ফাঁকে আমার লেখা চালিয়ে যেতে লাগলাম, রান্নাঘরে একটি খাতা, একটি কলম সঙ্গে রাখতাম। যখনই প্লট মাথায় আসতো তখনি কিছু লিখে ফেলতাম, রাত্রে ছেলে–মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে লিখতাম-’
তাই তো আমি পরম বিস্ময়ে বলি– কতটা ধৈর্য, কতটা কষ্ট সহিষ্ণুতা, কতটা ত্যাগী মনোভাবে এসব মহীয়সী নারীকে বিধাতা গড়েছিলেন। মনে পড়ছে বার বার তাঁকে। আত্ম প্রচারে বিমুখ, বিনয়ী এবং অসম্ভব নম্র স্বভাবের মমতাজ সবুর আর এখন মনে হচ্ছে কেন তাঁকে সব সময় মনে হতো এক বিষণ্নতার চাদরে যেন ঢাকা তিনি!
তাঁর লেখা গল্পগুলোতে যেন পাওয়া যায় জীবনের রোদ ছায়াময় দুরন্ত দুপুরের গল্প শিল্পগত ভাবনায় একেবারে নিটোল সহজ সরল ভাষায় এর প্রতিটি ছত্রে যেন বাস্তবতার নির্মম প্রকাশ, তবে শুধুমাত্র গল্পে নয়, সাহিত্যের নানা শাখায় ভ্রমণ করেছেন তিনি– একের পর এক জগৎ তৈরি করেছেন নীরবে নিভৃতে জনপ্রিয়তার কথিত জোয়ার থেকে আড়ালে থেকে, জীবন সংগ্রামে নিবেদিত থেকেও সঙ্গী করে নিয়েছেন লেখালেখিকে, একজন নারীর পক্ষে এটি যে কতটা দুঃসাধ্য, কতটা মনের জোর দরকার আর সবকিছুকে তিনি যেন সামাল দিয়েছেন নিয়তিকে মেনে নেওয়ার মত করে। হয়তো গভীর মনোবেদনায় এক সাগর অতৃপ্তি নিয়ে এক সময়ে বিদায় নিয়েছেন এ পৃথিবী থেকে, কিন্তু এরপরেও রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টি সুধা এবং এক গুচ্ছ রজনীগন্ধার মত সুশিক্ষিত সন্তান–সন্ততি যাঁরা মাকে ভালোবেসে তাঁর কীর্তিকে অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াসে নিবেদিত হয়েছেন।
মমতাজ সবুরের ‘আমার স্মৃতি আমার জীবন’ আত্মজৈবনিক এ গ্রন্থটি পড়তে পড়তে উপলব্ধির গভীরে আমার এক ধরনের কষ্ট কেবলি মনে হয়েছে, এ সমাজে মেয়েদের অবস্থান এখনো কতটা কঠিন। মনে হয়েছে কর্তব্য জিনিসটা যেন মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। চারিদিক থেকে যা উদ্যত খড়গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে– অতি সাবধানে সবার মন যুগিয়ে চলা। স্বাধীন নির্ভীকভাবে নিজের মনোমত পথে যাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আর এত কিছুর মধ্যেও মমতাজ সবুরের মত কয়জন পারেন নিজের সৃষ্টিকে ধরে রাখতে। তিনি পেরেছেন এবং তাই আমাদের নারী সমাজের জন্য এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছেন। সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে, আর একই সাথে মেয়েদের অবস্থানও শিক্ষা ও সৃজনশীলতায় এগিয়ে যাচ্ছে, মেয়েরা দৃপ্ত পদে, যদিও শঙ্কা আছে পায়ে পায়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নিরাপত্তাহীনতা এখনো রয়ে গেছে রক্তে মিশে যাওয়ার মত। আর পরিবারেও মেয়ের অধিকার এখনো অর্ধেক, এখনো বিয়ে সহজ সমাধান। অনেক ক্ষেত্রে অনেক মেয়ে এখনো নিজের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন নয়। আর সাহিত্য বা শিল্পকাজে মেয়েদের অবদান কোনোভাবেই কম নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে অবস্থানগত সীমাবদ্ধতা সবচাইতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের সাথে সৃষ্টিশীলতার জন্য আপোশ কয়জন পারেন। এরপরেও যাঁরা পারেন তাঁরাই স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকেন ইতিহাসের পাতায়, যদিও অনেকের ইতিহাস লেখা হয় না। থেকে যান পর্দার অন্তরালে।
‘মমতাজ সবুর’– যাঁর শৈশবে–কৈশোরে প্রতিভাদীপ্ত একটা মনন ও মেধার প্রকাশ ঘটছিল সেটাও আরো অনেকদূর বিস্তৃত হতে পারতো। কিন্তু যতটুকু যাবার কথা, যতটুকু স্বীকৃতি পাওয়ার কথা, তা হয়ে ওঠেনি। এরপরেও ভালো লাগছে তাঁর যোগ্য সন্তানেরা পরম মমতায় ভালোবাসায় এ দায়িত্বটুকু নিয়েছেন ‘মমতাজ সবুর’– চিরবিদায়ের পরেও সবার হৃদয়ে জেগে থাকুন, যিনি চেতনার উন্মেষকাল থেকে, বৃত্তের আবর্ত ভেঙে ভেঙে– উঠে দাঁড়িয়েছেন আপন সৃষ্টি কর্মের উদ্ভাসিত আলোয়।
লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।