মন পোড়ে বাবা

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী | রবিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

তোমাকে যেতে হবে,তোমার অন্তিম যাত্রা। ঘিরে আছে তোমাকে তোমার আপনজনেরা, চলে যাবে তুমি অন্যকোথাও। তোমার প্রিয়জনদের শোকের মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে হারিয়ে যাচ্ছো কোন অজানার উদ্দেশ্যে। যে পথে তুমি একসময় হেঁটে বেরিয়েছো সেই পথেই যাচ্ছো এখন স্ট্রেচারে শুয়ে,এম্বুল্যান্সে উঠানো হলো তোমাকে, শেষ বিদায়ের উদ্দেশ্যে। ছুটে চলছে এম্বুল্যান্স তোমার নিথর দেহটাকে নিয়ে যে দেহটা গতকালও ছিলো একজন হাসিখুশী ভরা প্রানবন্ত মানুষের। বাবা, তুমি কি আগেরদিন ও ভেবেছিলে পরদিন তুমি হারিয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে, সমস্ত মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে অন্য জগতের বাসিন্দা হবে! যখন হাসপাতালে যাচ্ছিলে তখনও কি ভেবেছিলে তুমি আর তুমি হয়ে ফিরে আসবেনা! খুব জানতে ইচ্ছে করে বাবা শেষ ইঞ্জেকশনটা পুশ করার পর তোমার চোখগুলো যখন আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছিলো তখন তোমার ভাবনার মধ্যে কি ছিলো। মনে পড়ছিলো কি তোমার প্রিয়মুখগুলোর অসহায় দৃষ্টি বা বলতে চেয়েছিলে কাউকে কিছু? জানি কখনো জানা হবেনা এই নির্মম সত্যিগুলো। কেবল ভাবনার আকাশে ছুটোছুটি করবে এই অজানা ইচ্ছেগুলো। বাবা,তোমাকে বহন করা এম্বুলেন্স ছুটে চলছে এক অদ্ভুত শব্দ করে। গ্রামের পর গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দেওয়া এম্বুল্যান্সটা। একসময় সেই শব্দটাও থামলো, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসলো তোমার প্রিয় জায়গাটাতে যেখানে তোমার বিদায়ের প্রস্তুতি চলছে। সবাই ব্যস্ত তোমাকে নিয়ে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। কেউ তোমাকে সাবান,শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করাচ্ছে,কেউ পড়াচ্ছে চন্দন, কেউ বা ধূতি!

যে পোষাকে তোমাকে কোনদিন আমি দেখিনি সে পোশাকে তুমি আজ অচেনা এক বাবা! মনে হচ্ছিলো মুচকি মুচকি হাসিভরা একটা স্টাচু বসে আছে যার শরীর থেকে অদৃশ্য এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এভাবেই চলছে তোমার বিদায়ের আয়োজন। সে আয়োজন ও থেমে গেলো একটা সময়। তখনও ভাবছি সমস্ত আয়োজন পন্ড করে দিয়ে তুমি বলবে কেন তোমরা আমাকে এভাবে চিরবিদায় জানাচ্ছো আমি যে তোমাদের সাথেই আছি। না, সত্যি হলোনা আমার ভাবনা! তোমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানটায়, যেখানটায় তোমার এই পৃথিবীতে শেষ ঠিকানা। তোমার শরীরটা এখন আগুনের ভেতর, দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তোমার পরিপাটি হয়ে থাকা সমস্ত শরীর, তোমার নির্লিপ্ত হাসি, তোমার মায়াভরা চাহনী। তোমার চোখ,কান,নাক কোনকিছুই বুঝি আর অবশিষ্ট রইলো না। তোমার আঙুলের সুন্দর লম্বাটে নখগুলোও কি ছাই হয়ে গিয়েছিলো বাবা! কি যে কষ্ট হচ্ছিল তোমার,কি করে সহ্য করলে বাবা তুমি এই কষ্ট। আমার কানে বাজছিলো তোমার তীব্র আর্তনাদ যেটা এম্বুল্যান্সের শব্দের চাইতেও ভয়ঙ্কর।

এটাই বুঝি নিয়ম এভাবেই বুঝি মেনে নিতে হয় বাবা! মনে হচ্ছিলো সিনেমার কোন লোমহর্ষক দৃশ্য দেখছি, মুহূর্তের মধ্যেই জীবনটা ছাই হয়ে গেলো! একটু পর তোমাকে একা রেখে আমাদের চলে যেতে হবে,এরকম একটা দিনও যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য কোনদিন ভুলেও ভাবিনিতো বাবা। এভাবে জীবনের চাকা ঘুরতে ঘুরতে একসময় চাকাটাকেও যে থেমে যেতে হয়,আহারে জীবন! বাবা, জীবনের সমস্ত হিসেব নিকেশ পেছনে ফেলে তুমি আজ শেষ বিদায়ের পথে,সমাপ্ত হলো তোমাকে বিদায় জানানোর সমস্ত আয়োজন। আগুনের নিষ্ঠুরতার মধ্যে তোমাকে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো আমাদের গাড়ি। তোমাকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, যতদূর দেখা যায় শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম তুমি কোথাও আছো কিনা। হঠাৎ মনে হলো কেউ আমাকে চিৎকার করে বলছে এভাবে চলে যাসনা তোরা আমাকে একা ছেড়ে,আমি যে সবার সাথে থাকতে পছন্দ করি!

প্লিজ, যাসনা আমাকে ছেড়ে.. …..বাবা, এতটা স্বার্থপর আমি কি করে হলাম বলো সেই শীতের রাতে নির্জন অন্ধকারে তোমাকে একা রেখে ফিরে এলাম নিজের গন্তব্যে……আজ দশটা বছর তুমি নেই বাবা। হারিয়ে গেছো আমাদের কাছ থেকে,তারপরেও আছো সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। মন পোড়ে বাবা, ভীষণভাবে মন পোড়ে। তোমার ও কি পোড়ে মন আমাদের কথা মনে করে?

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিনয়ের মত গুণ যার আছে সে জগতপূজ্য
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে