মানব সভ্যতা উত্থানের বিকাশের চাবিকাঠি ছিল কৃষি। ইতিহাসে কৃষিকাজের সূত্রপাত হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে। সৌদি আরব মরুভূমির দেশ। ১৯৩০–এর দশকের শেষের দিকে যখন তেল আবিষ্কৃত হয়, তখন সৌদি আরব ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে একটি। তখন পর্যন্ত স্থানীয় সৌদিদের অন্যতম পেশা ছিল পশুপালন ও খেজুর উৎপাদন। অন্য আরব দেশের মতো সৌদি আরব ছিল পুরোপুরি মরুভূমি। মরুময় অঞ্চলে কোন ধরনের চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদন হত না।
আশির দশকে বাংলাদেশীরা শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরব যাওয়া শুরু করে। তাদের হাত ধরে ঊষর মরুর ধূসর বুকেই কিনা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সবুজের জয়গান। একেবারেই নিষ্ফলা বালি ও কাঁকরময় মরুভূমিকে পরিণত করেছেন ফসল উৎপাদনের উপযোগী ক্ষেত্র হিসেবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর রয়েছে কৃষির প্রতি টান। রয়েছে মাটির প্রতি অন্যরকম মমতা। অনাবাদি, পতিত ও বালি–কাঁকর মেশানো যেমন মাটিই হোক অথবা আবাদি ভূমির ব্যবস্থা না থাকলেও জৈব উপাদান ব্যবহার করে তাতে ফল, ফুল, সবজি ফলিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন একজন বাংলাদেশী। প্রবাসের মাটিতেও বাংলাদেশীদের কৃষি সাফল্য–সুনাম কুড়িয়েছে সর্বত্র। সৌদি আরবের মদিনা থেকে উত্তর দিকে ১৪ কিলোমিটার দূরে হাইয়াল আল জাহরা নামক এলাকাটি বাংলাদেশীদের হাতের ছোঁয়ায় পরিণত হয়েছে কৃষি নগরীতে। ওই স্থানে প্রায় এক বর্গকি.মি আয়তনের খামারে আলো, তাপ, পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলছে ওই খামারগুলো। উৎপাদন হচ্ছে বিভিন্ন রকম ফুল ও ঔষধি গাছ। প্রবাসীরা আরবের মরুভূমিকে ফুলের বাগান করে চলেছেন। একশ প্রজাতির ফুল ও ঔষধি গাছ রয়েছে এই বাগানে। বিভিন্ন দেশ থেকে ঔষধি ও ফুলের গাছের চারা নিয়ে এসে কলম করার পরে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে বিক্রয় উপযোগী হলে সৌদি আরবের বিভিন্ন প্রদেশে বিক্রি করেন। মদিনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিলমাসিহ নামক স্থানে মরুভূমির মাঝে একটি কৃষিখামার গড়ে তুলেছেন এক প্রবাসী বাংলাদেশীর দক্ষ নেতৃত্বে। একে আরবি ভাষায় বলে ‘মাজরা’। ১৮০ বিঘা জমির এই কৃষিখামার ইজারা নিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার অন্তর্গত মির্জাখিল কুতুবপাড়ার ফজলুর রহমানের ছেলে আব্দুল মতলব। চারদিকে ধু ধু মরুভূমি। এর মাঝে এই খামারটি চলছে মূলত জেনারেটর ও গভীর নলকূপের সহায়তায়। বর্তমানে তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কখনও কখনও তা ৪৫–৫০ ছাড়িয়ে যায়। খামারটিতে মূলত করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, শিম, মরিচ, শিমলা মরিচ, কচু, ধনেপাতা ও নানান রকম শাক উৎপন্ন হয়। এছাড়া কিছু আম গাছ রয়েছে, যেগুলোতে প্রচুর আম হয়। রয়েছে বেশ কিছু মুরগি ও হাঁস। এছাড়াও মদিনায় সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত আলীতমা, আল ইশারা, কানিকিয়া, হিন্দিয়া, নাদাইয়া, জুমুরিয়া, সিলসিলা, খাইবার আল উলা। সৌদি আরবে ফসল উৎপাদন ভালো হয়। তবে বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। বীজ আনতে হয় বাইরের দেশ থেকে। প্রতি কেজি বীজ আনতে বাংলাদেশী ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। ফুল, শাক–সবজি, মাছ, হাঁস–মুরগি ছাড়া প্রচুর বাংলাদেশী খেজুর চাষে জড়িত। মদিনার খেজুর হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত। মদিনার আশেপাশে খেজুরের চাষ হয় আল বাইদা রোডে রয়েছে বয়ার, জদীদা, সেঁজুয়া, মিলেনিয়া, আলীতমা, আল ইশারা, ফরসা, ইউমুরিয়া, কানিখিয়ায়। এছাড়াও তরিখ তাবুকে বেশ খেজুরের মাজরা রয়েছে। আগে কম হলেও এখন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী খেজুর চাষে সাফল্য দেখাচ্ছে।
প্রবাস জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে অনেকে বেড়াতে যান এসব কৃষি–খামারে। অনেকে বন্ধু–বান্ধবসহ সপরিবারে বনভোজনের আয়োজন করেন। মোটের ওপর উদ্যোক্তা ও চাষীরা দেহের শ্রমে–ঘামে যা আয় করছেন, তাতে তারা সন্তুষ্ট।
দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ শ্রমিক নিয়ে আসতে পারলে দেশের রেমিট্যান্স বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশী কৃষি খামারগুলোতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্রবাসীরা।
সৌদি আরবে যে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছে তা বাংলাদেশীদের হাত ধরে। বর্তমানে মরুর বুকে সবজি ও মাছ চাষ ৮০–৯০% উৎপাদন হয় বাংলাদেশীদের মাধ্যমে। বাকী ২০–১০% হয় সৌদি আরব ও অন্যান্য প্রবাসীদের মাধ্যমে।
মরুর বুকে সবুজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী প্রবাসীদের সৌদি কর্তৃপক্ষ যদি সহযোগিতার হাত বাড়ায়, ইকামা প্রদানে শর্ত শিথিল করে এবং সৌদি আরবে নিয়োজিত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতসহ সরকারের কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ভূমিকা রাখে প্রবাসীরা আরো বেশি সফলতা দেখাতে পারবে, সৌদি আরব সবুজ শাক–সবজিতে স্বনির্ভর হবে এবং বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।