করোনা মানুষের জীবনকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে। আবার এ শিক্ষাও দিয়েছে যে, প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা নয়, প্রতিযোগিতা নয়। তাকে সঙ্গে নিয়েই মানব সমাজকে থাকতে হবে সহ–অবস্থানে। সাত মাস ধরে গৃহবন্দী মানুষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সব বন্ধের তালিকায়। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সংক্রমণের ঝুঁকি। আসন্ন শীতে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তার মানে করোনা থাকবে আরো অনেকদিন।
করোনায় গৃহবন্দী সংস্কৃতিকর্মীদের দিন কাটছে ওয়েবিনার, ফেসবুক লাইভ নিয়ে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ও কথাসুন্দর নাট্য দলের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ড. কুন্তল বড়ুয়া আজাদীকে বলেন, ঢাকায় কিছু কিছু দল নাটক মঞ্চায়ন করছেন। দর্শক হচ্ছে কিনা সে খবর জানা নেই। এমনিতে থিয়েটারের দর্শক হাতে গোনা। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী সন্নিকটে। ৫০ বছরেও আমরা দর্শক তৈরি করতে পারিনি। স্বাধীনতার পর যে শিল্প মাধ্যমটি সবচেয়ে শক্তিশালী বলে দাবি করি তা ‘নাটক’ বা ‘থিয়েটার’।
তিনি বলেন, এখন আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। যদি থিয়েটার এত শক্তিশালী মাধ্যম হয়, তাহলে আমরা কেন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারলাম না? না থিয়েটারকে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে দিলাম না? এই কথাটা ভাবনায় আনা দরকার সমকালীন থিয়েটার কর্মীদের। সীমিতসংখ্যক দর্শক নিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমরা নাটক করে চলেছি, আর আত্মতুষ্টিতে ভুগছি।
ড. কুন্তল বড়ুয়া বলেন, চট্টগ্রামে দুটো মিলনায়তন আছে। যদি কর্তৃপক্ষ মিলনায়তন উন্মুক্ত করেন, অনেক দল হয়তো নাটক করবে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। সংগঠনের পাশাপাশি দর্শককেও হতে হবে সচেতন। আমি চাই মঞ্চ উন্মুক্ত হোক। আবার প্রাণ ফিরে পাক। তবে মঞ্চে নামার আগে একটু ভাবার অনুরোধ রইল। চট্টগ্রাম সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ী কল্যাণ সংস্থার সহসাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করিম। তিনি বলেন, বেঁচে থেকেও মনে হয় সবার কাছে মরে গেছি। সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে এত কথা শুনি যে, কী বলবো? কেন যে এই শিল্পের সাথে নিজেকে জড়িয়েছিলাম!
তিনি বলেন, সাত মাস ধরে মহামারীর সাথে যুদ্ধ করছি। এখন সব সেক্টর খুলে দেওয়া হয়েছে, শুধু আমরাই বন্দী। মনে হয় আমরাই করোনা নিয়ে ঘুরছি। এ দেশে শিল্পী সমাজ বা শিল্পের সাথে জড়িত মানুষ আছে, এই কথাটা সবাই ভুলে গেছে। আমরা তো কারো কাছে চাইতে পারি না। আমাদের শুধু কাজের অনুমতিটুকু দেওয়া হোক।
রেজাউল করিম বলেন, এই সাত মাস জমানো টাকা দিয়ে চলেছি। স্টাফদের বেতন, ঘর ভাড়া, অফিস ভাড়া, পারিবারিক খরচ চালানো বসে বসে আর সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের স্টাফরা তো অন্য কিছু করতে জানে না। পুরনো স্টাফরা কই যাবে, কী করবে? আমি নিজেও আর টানতে পারছি না। এভাবে চললে আগামীতে এ কাজের জন্য কোনো টেকনিশিয়ান বা ক্রু পাবো না। কেউ আর এ কাজে আসবে না। কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। নিজের অবস্থা যেখানে শোচনীয়, সেখানে এইসব ইন্সট্রুমেন্ট ঠিক করবো কীভাবে?
বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী বনানী শেখর রুদ্র বলেন, সংস্কৃতি হলো সমগ্র জাতির দীর্ঘ সময়ের চিন্তা চেতনার ফলন। ভাবধারা ও কর্মকাণ্ডের গৌরবময় প্রতিচ্ছবি। করোনা মহামারী গত সাত মাস পৃথিবীব্যাপী সমস্ত কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা নিয়ে এসেছে, তা প্রত্যেকের জীবনে কম বেশি অভিশাপের মতো।
করোনা বিপর্যয়ে এ দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে এ মহামারীতে হারিয়ে গেছেন। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। কিন্তু যারা মঞ্চে অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের ব্যাপারেও ভাবা উচিত; বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পেশাদার শিল্পীদের কথা। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে সরকারের সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে গোটা সংস্কৃতি জগতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সীমিত পরিসরে হলেও দ্রুত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরুর সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুষ্ঠান করার অনুমতি পেলে শুরু হবে নতুন পথচলা। সকল বিপর্যয় কাটিয়ে হতাশ সংস্কৃতিকর্মীরা দেখবেন আশার আলো।