ভ্রমণ হোক আনন্দের ভ্রমণ হোক সমপ্রীতির

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | সোমবার , ১৯ আগস্ট, ২০২৪ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

আনন্দ ভ্রমণ, তীর্থ ভ্রমণ কিংবা সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে যেকোনো ভ্রমণই হোকনা কেন ভ্রমণ আমার কাছে অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি নিয়ে আসে। আইরিশ কবি ও নাট্যকার অসকার ওয়াইল্ড বলেছেন কোনো অজুহাত ছাড়া জীবনে বাঁচুন, কোনো অনুশোচনা ছাড়া ভ্রমণ করুন । কেননা ভ্রমণ দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, ধর্মীয় ও ভৌগোলিক পরিবেশ সম্পর্কে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যময় অনুভূতি এনে দেয় মানুষের সুকুমার হৃদয় নিভৃতে। ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক সেন্ট অগাইস্টানের মতে পুরো পৃথিবী একটা বই এবং যারা ভ্রমণ করে না তারা কেবল একটি মাত্র পৃষ্ঠা পড়েন । কাজেই ভ্রমণটা প্রতিবারই আমার মনে অপার আনন্দের সুখস্মৃতি হয়ে বিরাজ করে। জুন ২৪ এর শেষের দিকে কালকাতায় বসবাসরত আমার প্রয়াত সম্বন্ধী অধ্যাপক অরবিন্দ বড়ুয়ার সহধর্মিণী অধ্যাপক মৈত্রী বড়ুয়ার সাথে ফোনালাপে জানতে পারি তাঁদের বুদ্ধগয়া ও সারানাথ ভ্রমণের পরিকল্পনার কথা। সঙ্গী সাথী পাব, তাই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।

৯জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সকাল পৌনে নয়টায় হজরত শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পথে রওনা হয়ে ৯.১০ মিনিট সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। ১১.৩০ মিনিট সময়ে আমাদের বহনকারী ইউ এস বাংলার ফ্লাইট শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর স্থানীয় সময় ১১.৫৫ মিনিটে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় আত্মীয়ের বাসায় রাতটি কাটিয়ে পরদিন সকাল ৮.৪৫ মিনিট সময়ে আবারো নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। ১০.৩০ মিনিট সময়ে আমাদের ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর স্থানীয় সময় ১১.৩০ মিনিটে বুদ্ধগয়া বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সীক্যাব যোগে ১২.০৫ মিনিট সময়ে বুদ্ধগয়া পৌঁছে যাই। বুদ্ধগয়া মূল মন্দির সংলগ্ন মহাবোধি রেস্টহাউজ এ আমার সফরসঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল বিধায় আমি একটু আগেই বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট মনেস্টারি গেইটে নেমে যাই। আমার থাকার কক্ষে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে সরাসরি ডাইনিং রুমে পৌঁছেই ব্যুফে সিস্টেমে খাবার প্লেটে নিয়ে খেতে বসলাম।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমাদের বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট মনেস্টারি যেন ভীনদেশে একটি ছোট্ট বাংলাদেশ। আর বিহারটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন পাকিস্তান সময় থেকে পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বিশ্ব বৌদ্ধদের কাছে বাঙালি বৌদ্ধদের পরিচয় দানকারী কিংবদন্তী বৌদ্ধনেতা, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার ২৪তম মহাসংঘনায়ক,বাংলার নব অতীশ প্রয়াত শ্রীসদ্ধর্মভানক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের। এ মহান পুণ্য পুরুষের নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত রেখে বিহারের প্রধান অধ্যক্ষ ড.কল্যাণ প্রিয় মহাথের ও অন্যান্য ভিক্ষুসংঘ আপ্যায়ন, আতিথেয়তা ও সেবা দিয়ে আসছেন দেশী বিদেশী, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল সমপ্রদায়ের জনগণকে। তাঁদের আতিথেয়তার কথা দেশে থেকে অনেকের মুখে শুনে গর্ববোধ করি। অপরাহ্নের চা পর্ব শেষে পবিত্র বুদ্ধগয়ার মূল মন্দির দর্শনে যাই। এ মন্দিরের পাশ্ববর্তী বোধি বৃক্ষের নীচে ৬ বছর বজ্রাসনে কঠোরভাবে ধ্যানমগ্ন থেকে ২৫৬৮ বছর পূর্বে গৌতম সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব বা মহাবোধি জ্ঞান লাভ করেছিলেন।

পরদিন ১১ জুলাই ঘুম ভাঙার সাথে সাথে আমাদের মন্দির সংলগ্ন এলাকার মসজিদ থেকে আযানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসতে শুনি । আমি আগেই বলেছি আমাদের বিহারটি একটি মিনি বাংলাদেশ। কারণ এখানে অবস্থানরত ভিক্ষুসংঘ এবং তীর্থযাত্রী হিসেবে আসা প্রায় সবাই বাংলাদেশের চট্টগ্রামের লোক। কাজেই বৌদ্ধ বিহারে সূত্র পাঠ এবং মসজিদের আযানের ধ্বনি ঘুমের ঘোরে শুনলে যেকেউ ভাববেন তিনি বাংলাদেশেই আছেন। একটু দূরের হিন্দু মন্দির থেকে ধর্মীয় বন্দনা গীতির সাথে শঙ্কধ্বনির সুরও ভেসে আসছিল। এ যেন ভীন দেশের ভিন্ন পরিবেশে ধর্মীয় বিভেদের প্রাচীর ভেঙে সকল ধর্মের মর্মবাণী প্রচারে অভিন্ন ঐকতানের সুরমূর্চ্ছণা। ঐদিন দুপুরে সুজাতা কর্তৃক ধ্যানমগ্ন সিদ্ধার্থ গৌতমকে পায়েস দান এবং তাঁর পিত্রালয়ের বাস্তুভিটা পরিদর্শনে যাই।

১২জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে আমার প্রয়াত পিতৃপুরুষেরা, প্রয়াত পিতামাতা ও প্রয়াত সহধর্মিণী ও পরিবারের সামপ্রতিক কালে প্রয়াত সকল আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীদের স্মরণে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট মনেস্টারি হলরুমে মহৎ সংঘদান ও অট্টপরিখার দানের মাধ্যমে সকলের পারলৌকিক শান্তি ও নির্বাণ সুখ প্রার্থনা করেছি। পবিত্র বুদ্ধগয়ার মাটিতে তিনদিন দিনরাত অবস্থান শেষে ১৩ জুলাই ২০২৪খ্রিস্টাব্দ সকাল ৭.১৫ মিনিট সময়ে সড়ক পথে সারানাথের পথে রওনা হয়ে বেলা ১.৩০মিনিট সময়ে শ্রীলঙ্কান জম্বুদ্বীপ বিহারের রেস্টহাউজ এ পৌঁছে যাই। মধ্যাহ্ন আহার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় বিদেশি বৌদ্ধ দেশের নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে আসি।

১৪ জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৯টায় রেস্টহাউজ থেকে বেরিয়ে সারানাথের একটি শ্রীলঙ্কান মন্দির দর্শন করে বৌদ্ধদের অন্যতম প্রধান পবিত্র স্থান সারানাথ মূলগন্ধ কুঠি পরিদর্শনে যাই। যায়গাটির প্রাচীন নাম ঈষিপতন মৃগদায় যা তখনকার সময়ে হরিণের আবাসভূমি নামে খ্যাত। তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষের নীচে বসে বুদ্ধত্ব লাভের পর সারানাথের মূলগন্ধ কুঠি চত্বরে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিকট প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র পাঠ করেছিলেন। সন্ধ্যায় বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশের কয়েকটি মন্দির দর্শন করে রেস্টহাউজ এ ফিরে আসি।

১৫ জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৯ টায় ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সারানাথ প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর পরিদর্শন করি। সেখানে অনেক পুরাকীর্তির মাঝে বৌদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনেক পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাই। সকাল ১০.৩০মিনিট সময়ে বৌদি মৈত্রী বড়ুয়া ও তাঁর কন্যা সুদীপ্তা বড়ুয়া কর্তৃক আয়োজিত শ্রীলঙ্কান বিহারে এক দানীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও মধ্যাহ্ন ভোজন শেষে জম্বুদ্বীপ বিহারে ফিরে আসি। ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে ইতিহাস প্রসিদ্ধ বেনারস শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ি। বেনারস শহরে পৌঁছে শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের চারপাশ ঘুরে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদগুলোর অবস্থান এ বিদ্যাপীঠের বিশালত্ব প্রমাণ করে।

পরদিন ১৬ জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সকাল ৮.৩০মিনিট সময়ে টটো চালক শিবকে নিয়ে বেনারসে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থান গঙ্গানদীর ঘাট দেখতে যাই। উল্লেখ করা যায় যে এখানে ধনু আকৃতির নদী কিনারায় চার মাইল এলাকাজুড়ে ৮৪টি ঘাট রয়েছে যারমধ্যে অধিকাংশ ঘাটে স্নান এবং পূজা অর্চনা চলে, বাকী ২টায় শ্মশান ও সৎকার কর্মাদি সম্পাদন করা হয়। মোদি সরকার কর্তৃক সামপ্রতিককালে সংস্কার করা নমঘাট পরিদর্শন করে গঙ্গাঘাট দেখার আনন্দানুভূতি নিয়ে ১০.৩০ মিনিটে জম্বুদ্বীপ বিহারে ফিরে আসি। মধ্যাহ্ন আহার শেষে সারানাথ দর্শনের শেষ সন্ধ্যায় মূলগন্ধ কুঠি সংলগ্ন স্পিরিচুয়াল গার্ডেন ও তথাগত বুদ্ধের সাথে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের প্রথম সাক্ষাতের স্থানটি দেখে আসি।

১৭ জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ সকাল ৭.১৫ মিনিট সময়ে জম্বুদ্বীপ বিহারের রেস্টহাউজ ছেড়ে বেনারস লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমাদের ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের বেনারস কোলকাতা ফ্লাইট যথাসময়ে ৯.৪০মিনিটে আকাশে উড্ডয়নের পর সকাল ১১টায় নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দর সংলগ্ন তেঘরিয়াস্থ আত্মীয়ের বাসায় সেরাত এবং পরবর্তী দিন বিশ্রাম নিয়ে চট্টগ্রাম ফেরার অপেক্ষায় থাকলাম। চট্টগ্রাম মুখী ইউ এস বাংলার ফ্লাইট ধরার জন্য ১৯ জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ তেঘরিয়া থেকে সকাল ১০টায় নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। আধঘন্টা বিলম্বে ছেড়ে আমাদের ফ্লাইট স্থানীয় সময় ৩.২০ মিনিটে শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে অপেক্ষারত চিন্ময়, নাতি পাপ্পু ও ইউএস বাংলায় কর্মরত চিন্ময়ের সজীবকে নিয়ে বাসার পথে রওনা হয়ে স্থানীয় সময় ৪.১৫ মিনিটে বাসায় এসে পৌঁছি।

সারানাথ বেনারস ঘুরে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির কিছু চিত্রও চোখে পড়েছে। একটি চায়ের দোকানে চা পান করার সময় দেখি হিন্দু মুসলিম একই দোকান থেকে মাটির কাপে করে চা পান করছিলো। সেক্ষেত্রে দোকান মালিক কোন সমপ্রদায় ভুক্ত তা জানার যেন প্রশ্নই ওঠেনা। কবি নজরুলের ভাষায় বলা যায় :-“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন “? কাজেই কবি নজরুলের সাম্যবাদী কবিতার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে আমাদের প্রার্থনা ও ফরিয়াদ হোক :-

গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধমুসলিমক্রীশ্চান

৪দিন সারানাথ এবং বেনারস ঘোরাঘুরির সময় শয়ে শয়ে মুসলিম নারীদের মোটর সাইকেল /মোটর বাইক চালিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হয়নি ভারতবর্ষ নামের দেশটির কোনো একটি শহরে ছিলাম মনে হয়েছিল আমার স্বদেশভূমি বাংলাদেশেই ছিলাম। ধর্মীয় বিভেদ, কুসংস্কার ভুলে গিয়ে শান্তি, সহনশীলতা ও অসামপ্রদায়িক চেতনায় উদ্দীপ্ত থেকে আমার দেখা সারানাথবেনারসের সহাবস্থান ও বোধগয়ার আযানের সুর যদি জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার অন্তরে অনুরণিত হয় তাহলে মানবধর্ম রক্ষা পাবেমানবতা সুরক্ষিত হবে এবং মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ হবে। আর তখনই কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারবো – ” এ হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই। আমার দীর্ঘ ১১দিনের বুদ্ধগয়া, সারানাথ ও বেনারস সফর খুবই আনন্দদায়ক ও মনোমুগ্ধকর ছিল। সবশেষে এটুকুই বলবো, ভ্রমণ হোক আনন্দের, ভ্রমণ হোক সমপ্রীতির মেলবন্ধন।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনজরুলের অসামপ্রদায়িক চেতনা
পরবর্তী নিবন্ধনাটক ও নাট্যজনের সন্ধানে