ভ্যাট-শুল্ক প্রত্যাহার ও খরচ কমানোর পরামর্শ বিএনপির

রাজস্ব আয়ের অন্য উপায় খুঁজতে বললেন ফখরুল মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করুন মহার্ঘ ভাতা সমস্যা সৃষ্টি করবে

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর বসানো ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে রাজস্ব আয়ের অন্য উপায় খুঁজতেও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। গতকাল শনিবার সকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপে সাধারণ মানুষের ওপরে এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরেন তিনি। ফখরুল বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তথা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই একশর বেশি পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে এবং কিছু পণ্যের কর অব্যাহতি তুলে নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে, চাপ বাড়াবে। বিএনপি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণের জীবনের ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা সাধারণ জনগণের ওপর কর এবং ভ্যাট তথা পরোক্ষ কর আরোপের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি। খবর বিডিনিউজের।

নতুন করারোপের কী কী প্রভাব পড়বে তা তুলে ধরে একসময় অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষকতা করে আসা বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী মহলসহ আর্থিক খাতে সংশ্লিষ্ট নানা মহলের তীব্র অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের চরম ঘাটতি রয়েছে। এমনিতেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এই ভঙ্গুর অবস্থায় সহজ রাস্তায় হেঁটে ভ্যাটের হার তথা কর বাড়িয়ে সরকার খরচ মেটানোর চেষ্টা করলে তা দেশের জনগণের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না।

সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা পূর্বেও বলেছি, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাব। তাই সরকারকে অনুরোধ করছি, আপনারা নীতিমালা প্রণয়নে জনগণের কথা সর্বপ্রথম বিবেচনায় নিন। আপনারা পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিন। কারণ পরোক্ষ কর সকল শ্রেণির মানুষকে প্রায় সমানভাবে প্রভাবিত করে এবং নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর বোঝা বাড়ায়। প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়েও সরকারি খরচ কমিয়ে এবং চলতি বাজেটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পুনর্বিন্যাস করেও চলমান আর্থিক সমস্যার সমাধান করা যায়।

খরচ কমানোর পরামর্শ : ফখরুল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের সর্বপ্রথম নজর দেওয়া উচিত খরচ কমানোর দিকে। আমরা মনে করি, সরকার তার উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় ও আর্থিকভাবে অযৌক্তিক প্রকল্পগুলো বাদ দিলে প্রায় ২০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব এবং এতে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সহায়ক হবে। পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার যদি স্থানীয় সরকারের বাজেট এবং ভর্তুকি খাতে খরচ কমায় এবং সার্বিকভাবে পরিচালন ব্যয় ১০ শতাংশ কমাতে পারে, তাহলে ন্যূনতম ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব। সরকার কর্তৃক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণের বাজেট কমিয়ে সাময়িকভাবে ব্যয় সাশ্রয় করতে পারে। ২০২৪২৫ অর্থবছরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৫০,৮৭৫ কোটি টাকা ঋণ বাজেট করা হয়েছিল। সরকার খরচ কমানোর মাধ্যমে বাজেটের ন্যূনতম ১ লাখ কোটি টাকা সাশ্রয় এবং ঘাটতি কমাতে পারে বলেও মত দেন ফখরুল।

সরকারে সমন্বয়হীনতার অভাব : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে, অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে। এই অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।

মেগা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধের পরামর্শ : অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেগা প্রজেক্টের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ আপাতত বন্ধ রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব বলেও মনে করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, পতিত সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বর্তমান বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার পরিমাণ ২০২৩২৪ অর্থবছরে ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নিজেদের স্বার্থে বছরের পর বছর বাড়ানো হয়েছে এগুলোর মেয়াদ। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে চলেছে হরিলুট। গত ১৪ বছরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে এমন লুটপাট হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর। শ্বেতপত্র কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশই লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়া বাজেটের এমন অনেক খাত রয়েছে, যেমন অবকাঠামো খাতগুলোতে বরাদ্দকৃত বাজেটের অধিকাংশ অর্থই ব্যয় করা সম্ভব হয় না। এ সকল খাতে তাদের বরাদ্দকৃত অর্থ হ্রাস করে বাজেটের আকারকে আরও যৌক্তিকভাবে ছোট করে আনা সম্ভব। এভাবে খরচ কমানোর পাশাপাশি সরকার এমন কিছু উৎস ও উপায় খুঁজে বের করতে পারে যা জনগণের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ ফেলবে না।

সংবাদ সম্মেলনে এনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লুটপাটের যে বাজেট তাদের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) প্রথম উচিত ছিল ওই লুটপাটের বাজেট বাদ দিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট এড্রেস করা। কিন্তু সেটা না করে ওই লুটপাটের বাজেট বাস্তবায়ন করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব কঠিন কাজ। আমরা মনে করি, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের যে লুটপাটের বাজেট বাস্তবায়ন থেকে সরে এসে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দিয়ে এগুনো উচিত।

মহার্ঘ ভাতা নিঃসন্দেহে সমস্যা সৃষ্টি করবে : চলমান পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দিলে তা নিঃসন্দেহে সমস্যা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, সরকার যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এখানে এ ধরনের পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে কিছুটা সমস্যা তৈরি করবে।

এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ফখরুল বলেন, একই সময়ে মহার্ঘ ভাতা তো মুল্যস্ফীতি বাড়াবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের, তাদের তো কোনো আয় বাড়ছে না। এটা একটা সমস্যা। এই বিষয়গুলো আপাতত খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না।

নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সংকট দূর করা সম্ভব নয় তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সেজন্য আমরা একটা নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক সরকার তৈরিতে এত বেশি জোর দিচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহ উল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব শিক্ষা শ্রেণিকক্ষে পাওয়া যায় না, কিছু পরিবেশ-প্রকৃতি থেকে অর্জন করতে হয়
পরবর্তী নিবন্ধ৬৭ মেধাবীর পাশে লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্ট