হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে যৌথ পরিবার তথা একান্নবর্তী পরিবার। যৌথ পরিবার বা একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য। নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্র ও নাটক।
স্বর্ণালী অতীতের যৌথ পরিবারে সংসারের চিত্র ছিল ভিন্ন। সে যেন আজ রূপকথা। গল্পের প্রধান চরিত্রে থাকতেন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ। বিশেষ করে দাদা বা ঠাকুরদা। তিনি পরিবারের কর্তা। তিনি মহীরূহের মতো পুরো পরিবারকে ছায়া দিয়ে রাখতেন। সংসারের কর্ত্রী ছিলেন দাদি বা ঠাকুরমা। তিনি ছেলে বউদের হাতে সংসারের চাবি তুলে দিতেন এবং রান্নাবান্না সহ যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করতেন। নাতি নাতিনরা দাদি বা ঠাকুমার কাছে বড় হতো। ভুল ত্রুটি হলে দাদা/ ঠাকুরদা কিংবা দাদি/ ঠাকুরমা ছিলেন নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। ছোটোদের বিশ্বাস তারা রক্ষা করবেনই। ছোটদের কাছে দাদি বা ঠাকুরমা ছিলেন গল্পকথক। মনে হতো পৃথিবীর সব মজার গল্পগুলো শুধু দাদীরাই জানতেন। তবে বর্তমানে সমাজের আকাশ থেকে যৌথ পরিবার নামক নক্ষত্রগুলো খসে পড়েছে। কালের অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই সুমধুর অতীত। আর একক পরিবারের কালো ছায়ায় গড়ে উঠেছে স্বার্থপর ও হতাশাগ্রস্ত এক সমাজ।
সময় বদলেছে। আর বদলে যাচ্ছে মূল্যবোধ। আগে যৌথ পরিবারগুলো যখন একসাথে ছিল তখন নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করত না। এমন পরিবার ছিল যেখানে সন্তানকে নিজেকে দেখতে হতো না। বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছেই আদরে লালন পালনে তারা বড় হয়ে উঠতো। একজনের সন্তানকে আরেকজন শাসন করতে পারতো। সে ক্ষেত্রে বাবা–মা নীরব ভূমিকা পালন করতেন। কেননা সন্তানদের শিক্ষা দীক্ষা ও আদর্শে বড় করার সঠিক দিক নির্দেশনা যারা দিতেন তাদের শাসন করার অধিকারও ছিল।
আজকাল তেমন একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবার চোখে পড়ে না। আর বড় পাতিলে রান্না সে তো স্বপ্ন। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের ধাক্কায় পশ্চিমা সমাজে পরিবার নামক সংগঠনটি ভীষণ দুর্বল। আমরা তাদের ভালো দিক কখনোই অনুসরণ করিনি। আমরা অনুসরণ করেছি পশ্চিমাদের মন্দ দিকটি। করোনার ভয়াল গ্রাসে পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে, সুখে দুখে বিপদে আত্মীয়–স্বজনদের কত প্রয়োজন। একই ছাদের নিচে বসবাস করলে যেমন নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। তেমনি একে অপরের সহযোগিতায় দুঃখ ভুলে থাকা সম্ভব। যৌথ পরিবারে যে সন্তান গল্প, পড়ালেখা, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা এবং সামাজিকতায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে একক পরিবারের সেই সন্তান কখনোই তা পারে না। তাদের অবলম্বন ঘরের কাজের লোক (যদি বাবা–মা চাকরিজীবী হন) বা মোবাইল, ল্যাপটপ এসব নিয়েই সারাদিন পার করে। এ বিষয়ে যদিও অনেক বিতর্ক আছে। সব বাবা মা বা সন্তান কিন্তু এক নয়। তবে যৌথ পরিবারে থেকে সামাজিকভাবে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া একক পরিবারের একজন সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। যৌথ পরিবার ভাঙতে ভাঙতে এমন পর্যায়ে এসেছে এখন সন্তানেরা বাবা মাকেও ভাঙতে শুরু করেছে। অনেক পরিবারে এমন নজির রয়েছে বাবা কিছুদিন এই সন্তানের কাছে, মা কিছুদিন অন্য সন্তানের কাছে থাকছে। মাস হিসাবে তাদের খোরাকি চলে। কিংবা যারা একসময় পরিবারকে সকল রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা করেছেন, দেখা যায় সেই বয়োজ্যেষ্ঠদের ডাক্তার বদ্যি ঔষধপত্রেও সন্তানদের ভাগাভাগি পরিলক্ষিত। যৌথ পরিবার ভেঙে হয়েছে একক পরিবার। তাতেও শান্তি নেই। নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে মানুষ এখন মা–বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে। নিজের সন্তানদের মিথ্যে বলছে কিন্তু ভাবছে না কালের পরিক্রমায় সবার ভাগ্যে আবার একই চাকা ঘুরবে। অধুনা পশ্চিমা দেশগুলো যৌথ পরিবারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরে এই সংগঠনটিকে শক্তিশালী করার জন্য সুপরিকল্পিত কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। যাতে করে যৌথ পরিবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পায়। মানব সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছিল পরিবারকে কেন্দ্র করেই। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করা বড়ই প্রয়োজন। শিশু পালন ও বৃদ্ধ লালনে পরিবারের কোনও বিকল্প নেই। পরিবার আমাদের প্রথম পাঠশালা। যেখানে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাগুলো শিক্ষা গঠনের শক্তিশালী হাতিয়ার অর্জন করি। অর্থনৈতিক চাহিদার জন্য আজ সবার মন মানসিকতা কঠিন আবরণ দিয়ে গড়ে উঠেছে। তবে সম্মিলিত চেষ্টায় তা পূরণ করা সম্ভব।
পরিশেষে একথা বলা যায়– ব্যয় সংকোচ করে, সঠিক শ্রম বিভাজন, পারিবারিক ও সামাজিক সম্মান, নিরাপত্তা বিধান করতে পারলেই যৌথ পরিবারের সকল সুবিধা ভোগ করা যায়। যৌথ পরিবারের মানুষগুলো শুধু নিজ স্বার্থ সম্পত্তি মূলধন এসবকে চরিতার্থ করতে গিয়ে একক পরিবার সৃষ্টি করছে। অযথা আধুনিক শিক্ষার গায়ে কালিমা জ্ঞাপন করার কোনও মানে হয় না। এই পৃথিবীর সকল সন্তান তার বংশগরিমা মর্যাদা নিয়ে বড় হোক। দাদা–দাদির আদর সোহাগে স্নেহে ভালোবাসায় বোনের মমত্ববোধে গড়ে উঠুক তাদের বিশ্ব। হিংসাবোধ যেন তাদের গ্রাস না করে, একাকীত্ব যেন তাদের শৈশব ও কৈশোর কেড়ে না নেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, ‘যখন একা থাকার অভ্যাস হয়ে যায় ঠিক তখনই সৃষ্টিকর্তা কিছু মানুষের সন্ধান দেন। যখন তাদেরকে নিয়ে ভালো থাকার অভ্যাস হয়ে যায় ঠিক তখনই আবার একা হয়ে যেতে হয়’। তাই একা না হওয়ার লক্ষ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। সন্তানদের সহজ, সরল ও সৎ পথের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, কবি ও সংগীতশিল্পী।