ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এবং প্রসঙ্গ কথা

জসীম চৌধুরী সবুজ | সোমবার , ১৮ জুলাই, ২০২২ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

প্রায় একযুগ আগের কথা। এক সন্ধ্যায় আমার অফিসে আসেন এক সহপাঠী বন্ধু। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার। সৌজন্য আলাপ আলোচনার মাঝে তিনি তুললেন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। শহরের বাইরে যে এলাকায় বন্ধু কর্মরত সেখানে একটি সরকারি প্রকল্প হচ্ছে। যার জন্যে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এবার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পালা। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা সবাইকে জানিয়ে দিলেন ব্যাংক একাউন্ট না থাকলে টাকা পেতে সমস্যা হবে। তার ব্যাংকের লোকজন মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের একাউন্ট খুলতে সহায়তা করলেন। এদের অনেকেই কখনো ব্যাংকে যাননি বা যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। বিভিন্ন ব্যাংকে ক্ষতিগ্রস্তরা একাউন্ট খুললেন। এবার অপেক্ষার পালা টাকা পাওয়ার। ব্যাংক ম্যানেজারও আশাবাদী অনেকগুলো ক্ষতিপূরণের চেক জমা হলে তার অধিকাংশই স্থায়ী আমানত হিসেবে ওই ব্যাংকে থেকে যাবে।

কিন্তু তার সে আশায় পড়ল গুড়েবালি। জেলা প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভূমি মালিকদের নগরীর নির্দিষ্ট একটি এলাকায় একটি ব্যাংকের নাম জানিয়ে বললেন ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত পেতে হলে সেখানেই একাউন্ট খুলতে হবে। গ্রামীণ শাখায় যে একাউন্ট খোলা হয়েছে তাতে হবে না।

পরিমরি সবাই শহরে এসে আবার একাউন্ট খুললেন সেই নির্দিষ্ট শাখায়। ব্যাংক কর্মীরা বেশ সহায়তা করলেন। এবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পালা। ক্ষতিগ্রস্তদের দুই কিস্তিতে চেকের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হল। কারো পাওনা যদি এক কোটি টাকা হয় তাকে প্রথমে দেওয়া হল ৪০ লাখ টাকার চেক। সেই ক্ষতিপূরণের চেক ব্যাংকে জমা করার আগেই ব্যাংক ম্যানেজার সমপরিমাণ টাকার একটি চেক লিখিয়ে তাতে গ্রাহকের স্বাক্ষর নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। চেক কালেকশন হয়ে আসার পর তা ক্যাশ করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এটা তাদের কমিশনের অংশ। এখানে ব্যাংক ম্যানেজার সিন্ডিকেটের হয়ে কমিশন আদায় নিশ্চিত করতে কাজ করেন। কমিশন হাতে চলে আসার পর দ্বিতীয় কিস্তিতে বাকি ৬০ লাখ টাকার চেক ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক পেলেন। প্রশ্ন হল, ৪০ শতাংশ টাকা কমিশন হিসেবে কেটে রাখার পরও এ নিয়ে কেউ কোনো হৈ-চৈ বা উচ্চবাচ্য করলেন না কেন? কারণ এখানে দু’পক্ষের লাভ। মৌজা রেট বেশি দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকার জমি এক কোটি টাকায় অধিগ্রহণ। ৫০ লাখ টাকায় ২০ শতাংশ কমিশন কাটলে ক্ষতিগ্রস্ত পেতেন ৪০ লাখ টাকা। এখন দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করায় পেলেন ৬০ লাখ। লাভের উপরে লাভ। ক্ষতিগ্রস্তদের মোটিভেট করা হয় খেলে সরকারি টাকা খাচ্ছে, তোমার-আমার টাকাতো খাচ্ছে না। এই মোটিভেশন কাজটি করা হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে। তিনি বা তাদের সিন্ডিকেটে রাখা হয় বা রাখতে বাধ্য করা হয়। এরা একে অপরের পরিপূরক। কমিশন নিয়ে দু’একজন ঘাঁইগুই করতে চাইলে তার টাকা প্রাপ্তি আটকে দেওয়া হয় সেখানে অন্য কাউকে শরীকদার দেখিয়ে বা অন্য চলচূতোয় মামলা করে দিয়ে।

একসময় ভূমি হুকুম দখলকে অভিশাপ হিসেবে মনে করা হত। কোনো প্রকল্পে কারো জমি অধিগ্রহণ তালিকায় পড়লে তার ঘুম হারাম হয়ে যেত কিভাবে তা ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। প্রভাবশালীরা কৌশল বের করে নিজেদের জমি রক্ষা করতেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের জমির উপর দিয়ে সড়ক বা স্থাপনা হলে এলাকার জমি-জমার দাম বেড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্তরা বাস্তচ্যুত হয়ে কোথাও হারিয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা লাভবান হয়ে আরো বিত্তের মালিক হন। ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মিছিল- মানববন্ধন এসবও হত। ভূমি মালিকরা হয়রানির একশেষ হতেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ২০১০ বা ১১ সালের দিকে নতুন আইন করেন সরকারি কাজে কোনো ভূমি অধিগ্রহণ করতে হলে ক্ষতিগ্রস্তরা মৌজা রেটের তিনগুণ দাম পাবেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে। এতে ভূমি অধিগ্রহণ অভিশাপ থেকে আশীর্বাদে পরিণত হয়। এখন অধিগ্রহণ তালিকায় নিজের জমি অন্তর্ভুক্ত করতে তদবির চলে। আর সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে সিন্ডিকেট।

সম্প্রতি ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাড়ে ২৩ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভুমি হুকুম দখল (এলএ) শাখার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান। তিনি মাতারবাড়ি গভীর সমূদ্রবন্দরসহ কক্সবাজারে চলমান ১৫ টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তদন্ত করছে আতিকের এই টাকার উৎস কোথায় তা জানতে। ঘুষ- কমিশনের টাকা এটা নিশ্চিতও হয়তো হবে। চার্জশিটও হবে। কিন্তু মামলাটির শেষ পরিণতি কি হয় সেটা দেখার বিষয়। দু’দকের একজন উপপরিচালক শরীফ উদ্দীন এর আগে কক্সবাজারে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে ২ হাজার কোটি টাকার অনিয়মের তথ্য উদঘাটন করে ৭৩০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। এতে ১৫৫ জন আসামীর মধ্যে জেলা প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তা- কর্মচারীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকের নামও রয়েছে। এতে কাল হয়েছে শরীফ উদ্দীনের। তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সার্ভেয়ার আতিকের মামলা তদন্তে যদি রাঘব-বোয়ালদের নাম উঠে আসে তা নির্ভয়ে উন্মোচনের সাহস কি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা দেখাতে পারবেন? শরীফের পরিণতির ভয় এখানে কাজ করতে পারে এটাতো বলা যায়।

২০১৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী (চেইনম্যান) নজরুল ইসলাম গ্রেফতার হয়েছিলেন ৯১ লাখ টাকার চেক এবং নগদ ৭ লাখ টাকাসহ। চেকগুলো ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে কমিশন বাবদ অগ্রিম নিয়ে রাখা চেক। দুদক এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে খোঁজ পায় নজরুলের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের। তার ব্যাংক হিসাবে পাওয়া যায় ১০ কোটি টাকা। ২৫ হাজার টাকা বেতনের এই তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী চলেন ২৫ লাখ টাকা দামের গাড়িতে। স্ত্রী ও নিজের নামে অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, শপিং মলে একাধিক দোকান কতকিছুর মালিক তিনি।

২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর বস্তাভর্তি ৫৮ লাখ টাকাসহ ইলিয়াস ভূঁইয়া নামে একজন গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম আদালত ভবন চত্বর থেকে। পরে জানা যায় টাকার মালিক এলএ শাখার সার্ভেয়ার শহীদুল ইসলাম মুরাদ। এই ঘটনার পর তোলপাড় সৃষ্টি হলে গণবদলির মাধ্যমে দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করা হয়।

কক্সবাজারের বাহারছড়া এলাকা থেকে ৯৩ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন এলএ অফিসের সার্ভেয়ার ওয়াসিম। তার কাছ থেকে এর বাইরে কিছু চেকও পাওয়া গিয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ-কমিশনের অগ্রিম হিসেবে নেওয়া এসব চেক এবং সেই চেক ক্যাশ করা টাকা এসব। ঘুষ- কমিশনের টাকা-চেকসহ কেউ গ্রেফতার হলে ক’দিন এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলে। তারপর সব মিইয়ে যায়। মানুষও সব ভুলে যায়। সিন্ডিকেট আবার হয়ে ওঠে সক্রিয়। চলছে এভাবেই।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদ্যুৎ সঙ্কট : জ্বালানিখাতে সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল