রেহান, সবুজ আর আজলান ওরা তিন বন্ধু। বার্ষিক পরিক্ষা শেষ। স্কুল বন্ধ। শীত ঝেঁকে বসতে শুরু করেছে। তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলো কোথাও বেড়াতে যাবে। সেই মতে এক ছুটির সকালে পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে।
কী যে সুন্দর জায়গা। চারপাশে সবুজে ঘেরা, পাখির ডাক আর অজানা ফুলের মিষ্টি গন্ধ, সেখানকার পরিবেশটাও যেন এক কল্পনার রাজ্য। চারদিক ছিমছাম নিরবতা। বুনো পাখিদের কিচির মিচির সুমধুর গান আর পায়ের নিচে শুকনো ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি মনটা উদাস করে দেয়। নাম না জানা গাছের ছায়ায় পাখির গান, ঝরা পাতার শব্দ আর বাতাসের গুঞ্জন শুনতে শুনতে তিন বন্ধু খোশমেজাজে পায়েচলা পথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গভীর বনে চলে এসেছে টেরই পায়নি।
রেহান একটা পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলো। বলল–
– এই সবুজ দেখ দেখ, ঐ গাছের ফাঁক দিয়ে একটা মন্দিরের মতো দেখা যাচ্ছে। চল ওখানে যাই।
সবুজ বলল – আমার ভয় করছে, ওখানে সাপ বিচ্ছু থাকতে পারে। চল ফিরে যাই।
– এই ভিতুর ডিমটাকে আনাই ঠিক হয়নি।
সবুজকে টিপ্পনী কেটে আজলান আর রেহান মন্দিরের দিকে হাঁটতে লাগল। অগত্যা সবুজও ওদেরকে অনুসরণ করতে লাগল।
তারা কৌতূহলী হয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়লো। এ যেন এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। যত্র তত্র গজিয়ে উঠা বট পাকুড়ের ছড়াছড়ি। ইটসুড়কি ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কী যেন একটা সুড়ঙ্গ করে এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কার যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। কাউকেই দেখতে পেলোনা।
ধ্বংসাবশেষের ভেতরে একটা পুরনো কুঁয়া দেখতে পেল। সেই কুঁয়াটার ওপর একটা পুরনো লোহার ঢাকনা বসানো ছিলো। আজলান একটা ইটের টুকরো নিয়ে ঢাকনাটার উপর ছুঁড়ে মারে। ইটের আঘাতে ঢাকনাটাতে একটা বিকট আওয়াজ হলো। সেই মুহূর্তেই ভয়াবহ এক কণ্ঠস্বর শোনা গেলো,
“কে আমার ঘুম ভাঙলো?”
ভয়ে জমে গিয়েছিলো তিনজনই, কিন্তু সাহস করে রেহান বললো, “আমরা শুধু এখানে ঘুরতে এসেছি।”
কণ্ঠস্বর শোনার সাথে সাথে কুয়া থেকে কুন্ডলি পাকিয়ে ঘন সাদা ধোঁয়া আকাশ ছেয়ে এক দৈত্যের আকার ধারন করল। আবার বললো, “তোরা এক্ষুণি এখান থেকে চলে যা, নইলে তোদের এই মন্দিরে বন্দী করে রাখবো চিরকাল।”
তিন বন্ধু ভয়ে পড়িমড়ি পালানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু মন্দিরের দরজাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। তারা ভয়ে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগল।
আজলান বললো, “আমরা এখন কি করবো?”
এমন সময় সবুজ একটা পুরনো বই দেখতে পেলো, যা মন্দিরের এক কোণে পড়ে ছিলো। বইটা খুলে দেখলো, সেখানে লেখা ছিলো মন্দিরের দৈত্যের গল্প। দৈত্যটা এই মন্দিরের পাহারাদার, আর যারা তার ঘুম ভাঙে, তাদের সে ধরে বন্দী করে রাখে।
আরো লেখা ছিল– এই মন্ত্রটা পড়ে ক্ষমা চাইলে দৈত্যটা আবার ঘুমিয়ে পড়বে।
তিন বন্ধু ঠিক করলো, যে কুয়ার ঢাকনায় আঘাত করেছে, সে একটা মন্ত্রপাঠ করবে। আজলান বইটা পড়তে শুরু করলো, আর রেহান, সবুজ মন্ত্র পাঠের জন্য প্রস্তুতি নিলো।
মন্ত্রপাঠ শেষে তিন বন্ধু সমস্বরে বলল–
“ওহে দৈত্য, তোমার ঘুমে আমরা বিঘ্ন ঘটিয়েছি, ক্ষমা করো আমাদের। আমরা এখানে বন্ধুরা মিলে ঘুরতে এসেছি, অনিচ্ছাকৃতভাবে তোমার ঘুম ভাঙিয়েছি। অনুগ্রহ করে আমাদের মুক্তি দাও।”
মন্ত্র শেষ হতেই দৈত্যের কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেলো, “আমাকে দেখার পর কেউ আর ঠিক থাকতে পারেনা। অজ্ঞান হয়ে এখানেই মরে পড়ে থাকে। তোরা সাহসী, আর তোদের মধ্যে সততার প্রতিফলন আছে। আমি তোদের ক্ষমা করলাম। এবার এখান থেকে চলে যা।”
মন্দিরের দরজাটা আবার খুলে গেলো। তিন বন্ধু দ্রুত মন্দির থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি পথে পা বাড়ালো। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলো, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, যে আর কোনোদিনও ভূতুড়ে মন্দিরে ঢুকবে না।
এই অভিজ্ঞতার পর, তিন বন্ধুর সম্পর্ক আরও গভীর হলো। তারা বুঝতে পারলো, একে অন্যের সঙ্গে থাকার শক্তি আর সাহসের মাঝেই সত্যিকারের বন্ধুত্ব বিদ্যমান।
এই ভয়ংকর ঘটনাটি তাদের জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলো। তাদের মনে চিরকাল এই ভ্রমণের সাহসিকতার কাহিনী রোমাঞ্চের জন্ম দেবে