১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রাবাসে থাকতাম। তখনও রাজনীতি ছিল মূলত ছাত্রাবাস কেন্দ্রিক। সেই সময়টা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব রাজনীতির পিক আওয়ার। রাজনীতিতে মূলত বাম, উদারমধ্যপন্থী (ছাত্রলীগ) ও ধর্মীয় ছাত্র সংগঠন এই তিনটিই প্রধান ছিল। আমার সমস্যা ছিল তিনদলেই যথেষ্ট বন্ধু–বান্ধব ছিল। তবে ছাত্রাবাসের বেশিরভাগ বন্ধু উদার মধ্যপ্যন্থী হওয়ায় ভোটটা ওদেরকেই দিতাম। তখন আবার বন্ধু নির্বাচনটা এত বেশী মেরুকরণ ছিল না। যা–হোক স্বাধীনতার পর মেডিকেলে ভর্তি হয়ে রুম বরাদ্দ পেলাম ১–সি। ঠিক নীচ তলায় সিঁড়ির পাশে প্রথম রুম। তখনো রুমে সিট পেতে যারা অলরেডি আছে তারা রাজি থাকাটাও বিবেচ্য ছিল। ঐ রুমেই থাকতেন ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য প্রয়াত মন্ত্রী ডাঃ আফছারুল আমীন ভাই। তখন কোনো কোনো রুমে তিন রাজনৈতিক সংগঠনেরই ছাত্র থাকত। রুমে কোন সমস্যা হতো না, রাজনৈতিক মতভেদ ক্যাম্পাস ও ভোটের বাক্সে। এখন তিনজনই আমার মোটামুটি পূর্ব পরিচিত হলেও তিনজনই আমাকে রুমে গ্রহণ করতে একটু দ্বিধা গ্রস্ত ছিলেন। তিনজনই সিনিয়র। চট্টগ্রামের ছাত্র হওয়ায় কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। দুইজন চট্টগ্রাম কলেজের। একজন আবার বড় ভাইয়ের বন্ধু। তাদের দ্বিধার কারণটা ছিল–আমি একটু বেশি পড়ুয়া। অতএব রুমে আড্ডাটা ফ্রি স্টাইলে হবে না। অতএব এই ব্যাটাকে অন্যরুমে পাঠাও। রুম না পেয়ে আমি ভাবলাম কাউকে অনুরোধও করব না। যা হবার তা হবে। আমি গ্রামের বাড়ি থেকে ট্রেনে (সকল ৬ টা) যাতায়াত শুরু করলাম। দুপুর আড়াইটার পর ট্রেনে আবার গ্রামে চলে যেতাম। এভাবে ২–৩ সপ্তাহ পার করলাম। একদিন তারা আমাকে রুমে বরণ করে নিল। নেতা আফছার ভাই সারাদিন ঘুরে রাতে আসতেন। আরেক সিনিয়র আনোয়ারার মানুষ। একটা সাইকেল ছিল তাঁর। পারিবারিক কত মামলা ছিল কে জানে? শুধু সাইকেলে চড়ে কোর্ট বিল্ডিং যেতেন। আফছার ভাইয়ের কাছে অহরহ বন্ধু–বান্ধব আসত। কিন্তু আমি পড়তাম দেখে নেতা কোনদিন ওদেরকে নিয়ে রুমে আড্ডা দিতেন না। উনি সব সময় বাইরে বারান্দায় চলে যেতেন। আমিও আস্তে আস্তে বাকি তিনজনের ‘দোস্ত’ হয়ে গেলাম।
আফছার ভাই হোস্টেলে থাকলে ও কেন্টিনে খেতেন না। উনার জন্য কাট্টলী থেকে ভাত আনত টিফিন কেরিয়ারে করে। উনার টিফিন কেরিয়ার দেখে আমার খুব লোক হতো। রাত আটটার ভিতর হোস্টেলের ডিনার খেতাম। ২ ঘন্টা পর আবারো ক্ষিধা লাগত। রুমে ততক্ষণ আমি একাই থাকতাম। নেতা ছিলেন ঘোরা–ফেরায়, আর দুজন লাইব্রেরিতে পড়তেন। একদিন টিফিন কেরিয়ার খুললাম। দেখলাম মাগুর মাছ, সীমের বীচির ঝকঝকে তরকারী, হোস্টেলের খাবারে তো তৃপ্তি নেই। তাই সামান্য ভাত–আর মাগুর মাছের তরকারী তুলে খাওয়া শুরু করলাম। সেই যে শুরু আমি প্রায় সময় রাত দশটায় আফছার ভাইয়ের জন্য আনা খাবার থেকে ‘একটু’ খেয়ে তৃপ্তির শোকর করতাম। কিন্তুু এই নেতা কোনদিন জিজ্ঞেস করতেন না ভাতে চামচ লাগিয়ে তুলেছে কে? ঘুমানোর আগে জিজ্ঞেস করতাম মাছগুলো নিজস্ব না কেনা? (তখন উনাদের এলাকায় ডোবাতে বেশ মাছ পাওয়া যেত) নেতা বলতেন– খাইতেছ খাও, মাছ কোত্থেকে আসে জেনে তোমার কি লাভ? আমি এক বছর উনার রুমে ছিলাম। তারপর সরকারি বৃত্তিতে বুলগেরিয়া চলে যাই। নিয়মিত চিঠি–পত্র লিখতাম। কেউ দেশে আসলে “সিগারেট” ‘ও সেভিং ক্রীম’ পাঠাতাম। তখন কুরিয়ার ছিল না। কেবল হাত পার্শ্বেল পাঠানো যেত। ১৯৮৫ সালের দিকে আফছার ভাই রাজনীতিতে পোক্ত আসন নিয়ে নিয়েছেন চট্টগ্রামে। তবে তখনো ডাক্তারী চেম্বার ছাড়েন নি। সেই সময় রাজনীতি থেকে ডাক্তারীতে বেশ প্রসার ছিল। তার প্রেসক্রিপশনে ২–৩ টার বেশি ওষুধ থাকত না। পারিবারিকভাবে যেহেতু প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি অনেক উচ্চ বিত্তের লোককে আমার চিকিৎসায় রেফার করে দিতেন।
নেতার বা কোনো ‘ডনের’ লেজুড়বৃত্তি, চাটুকারিতা আফছার ভাইয়ের রক্তে ছিল না। রাজনীতিতে তার অবস্থান জনগণ কেন্দ্রিক, নেতা নির্ভর ছিল না। তার রাজনৈতিক জীবনের দিকে আমি যাব না। সামাজিক ক্ষেত্রে উনি বন্ধু–বাৎসল্য ছিলেন। শত রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততা সত্ত্বেও ডাক্তার বন্ধুদের সাথে অবধারিত ভাবে সময় কাটাতেন। তার নানার বাড়ি রাউজানের একটা বিশেষ পাড়ায়। এই পাড়ার মত এত আলোকিত মানুষ খুব কম এলাকায় দেখতে পাওয়া যায়। তার নানা, মার আত্মীয়দের মাঝে কয়েকজন নামকরা বৃটিশ আমলের ডাক্তার ছিলেন। নানার বাড়িতে তার ছোটকালের এক খেলার সাথী ছিল। জীবন পরিক্রমায় সেই বন্ধু রাউজান স্কুলের দফতরী ছিল। আফছার ভাই রাউজান সফরে গেলে দফতরীকে পাশে বসিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা শুরু করেন।
পরিপক্ষ রাজনীতিক হিসেবে কোনো বড় মাপের নেতার সাথে উনার কিছু বাদানুবাদ হয় মাঝে মধ্যে। এর কিছু কারণ রাজনৈতিক কূট কৌশলে অনভ্যস্ততা আর কিছু হয়তো পারিবারিক আভিজাত্যের প্রভাব। এসবই সাধারণ কর্মী বা উনার এলাকার জনগণের ভালোবাসায় কোন ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারেনি।
মৃত্যুর পূর্বের তিন–চার বছর উনার জীবনের দুর্যোগতম সময়। কারণ উনারা শুধু আরাম দেখেছেন, ব্যারাম কখনো দেখেননি। মরণব্যাধি ক্যানসারের সাথে যুদ্ধে খুব কম মানুষই জিতে। সর্বোচ্চ স্থানে চিকিৎসা নিয়েও ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। বছর খানেক আগে ন্যাম ভবনের মানিক মিয়া এভিন্যুর ফ্ল্যাটে দেখতে গিয়েছিলাম। আনন্দে এত উৎফুল্ল হলেন যে চোখে মুখে ভাবান্তর দেখলাম। আমার সাথে উনার কথাবার্তায় বড় সমস্যা ছিল আমি সিরিয়াস কিছু বললেও উনি ঠাট্টা–মশকারি দিয়ে জবাব দিতেন। যাহোক–শীর্ণকায় দেহ, দাঁড়াতেই পারছিলেন না ভর করে। তবুও দেয়ালে হতে দিয়ে লিফট পর্যন্ত আসবেনই। আমি যতই দরজার ভিতরে যেতে বলি ততই উনি আমার লিফট পর্যন্ত আসার জন্য বেপরোয়া। উনার বিদায়ী কন্ঠ ভারী হয়ে এল। ভারাক্রান্ত মনে লিফ্টে নেমে এলাম। ভাবলাম তরতজা এক তরুণের উচ্ছ্বসিত জীবনের বহু খণ্ডকাহিনী। সদা হাস্য এক মানুষ, একজন পুরোনো ধ্যানধারণার রাজনীতিক–না আছে হিংসা, না আছে কোন দুবৃত্তায়নের গন্ধ। শুধু দিয়েই গেছেন আম–জনতাকে। বিদায় রুমমেট বিদায়। বিদায় বন্ধু বিদায়, বিদায় সজ্জন রাজনীতিবিদ! আমার প্রয়াত পিতাকে ‘কাকু’ বলে আর কেউ ডাকবে না। আমাকেও ‘পাকা চুল’ বলে আর কেউ ডাকবে না। উনার পিএসকে আমি বলতাম–সাদা চুল ওয়ালা ডাক্তার আসছে বল! সাথে সাথে দরাজ গলায় হাঁকতেন কাটিরহাটের ‘কাকুর’ পোয়া–আইও। জীবনের প্রবাহে শরীরী মানুষের মৃত্যু থাকলেও আফছার ভাইয়ের অসংখ্য স্মৃতির রোমন্থন চিরায়ত! ডাক্তার ও রাজনীতিবিদের সহধর্মিণী হওয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। যোগ্য রাজনীতিবিদের যোগ্য সহধর্মিণী ডাঃ কামরুন্নেসা মায়া। সুঃখে–দুঃখে এই মহিলার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। দীর্ঘ অসুস্থতায় আফছার ভাইকে সর্বোতো সাহস, সেবা দেয়ার ব্যাপারে মায়া ভাবী আমার মনে হয় একটা রেকর্ড। আফছার ভাইয়ের দীর্ঘ টালমাটাল জীবনে এই চিকিৎসক নারীর ভূমিকাকে আজকের সামাজিক বাস্তবতায় হাজারো স্যালুট! লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।