মার্কিন বর্বরতা : আবু গরিব জেল
বিগত ৮০-৯০ বৎসর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মার্কিনিরা যত অপকর্ম, আর্থিক লুণ্ঠন, মানবিক অপরাধ- করেছে পুরো পাশ্চাত্য ঔপনিবেশ তত অপরাধ- করেনি। তার নৃতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। প্রাথমিক যুগের ইউরোপীয় বসতিকারী যারা মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছিল তারা ইউরোপে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল অধিকাংশই। অর্থাৎ শিক্ষিত ‘সেট্লার’ খুব কমই ছিল। ব্রিটিশ, ফরাসি ঔপনিবেশ তেমন ছিল না। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক ওকালতি করতেন কলকাতা হাইকোর্টে। কঠিন সব ইংরেজি বলতেন। এক ইংরেজ জজ তাকে কঠিন ইংরেজির ব্যবহারের জন্য উষ্মা প্রকাশ করলে- শেরে বাংলা বলেছিলেন- লন্ডনের রাস্তায় বেকার কিছু ভবঘুরেকে রাণী ভারতে জজ বানিয়ে পাঠিয়েছেন। দু’চারজন ছাড়া ব্রিটিশ-ফরাসি সাহেবরা মোটামুটি ভাল শিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু আমেরিকার বেলায় মোটেই ব্যাপারটা সে রকম ছিল না।
প্রথম ধাক্কায় দক্ষিণ ইটালির নেপলস শহরের জেল ভেঙে বিপুলসংখ্যক কয়েদি জাহাজে করে মার্কিন মুল্লুকে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় ধাক্কায় স্কটল্যান্ড। আয়ারল্যান্ড থেকে দাগি আসামিদেরকে সরকারই জাহাজে করে ‘নতুন মহাদেশে’ পাঠিয়ে দেয়। এদের বংশধররাই নতুন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর কোন দেশে ‘মাফিয়া-মাস্তানদের’ সম্মেলন হয়েছে বলে জানা নেই। ১৯৩১ সালে নিউইয়র্ক পৌর দফতরের (সিটি হল)-এর সন্নিকটে মেয়রের বিরুদ্ধে মাফিয়ারা সম্মেলন করেছিল। মার্কিন মুল্লুকে মার্জিত, শিক্ষিত ইউরোপীয়ানরা পাড়ি জমাতে থাকে ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে। ষাটের দশক থেকে তাবৎ বিশ্বের মেধাবীরা আমেরিকাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে নিয়ে যায়।
মার্কিন বর্বরতার প্রাথমিক শিকার পুরো দক্ষিণ আমেরিকা, কিউবা। হাল আমলে ভিয়েতনাম ও পুরো মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্যকে তছনছ করে দিয়েছে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।
ইরাক প্রাচীন সভ্যতার দেশ। মেসোপটমিয়া মানে দুই নদীর মাঝখানের ভূমি। মেসোপটমিয়া বা বর্তমান ইরাকের সভ্যতা যীশু খ্রিস্টের জন্মের ৬ হাজার বছর পূর্বের। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ আব্বাসীয় যুগে পুরো বিশ্বের জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেই নগরীকে ১২৫৮ সালে ধ্বংস করেছিল মঙ্গোলীয়ানরা। ২য় বার ধ্বংস করে মার্কিন যুদ্ধবাজ প্রশাসন। মার্কিনিরা গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে- এই অজুহাতে একটা দেশ তছনছ করে দেয়। মার্কিনীদের মিথ্যা প্রচারণা ‘সেল’- প্রচার করতেই থাকে যে প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে। বাস্তবে আজ অবধি মার্কিনিরা প্রমাণ করতে পারেনি। মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারী ও তেল কোম্পানিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ডলার ফায়দা লুটেছে। U.N Compensation কমিশন এর হিসেব অনুযায়ী ইরাক ১৯৯০ সালের কুয়েত আক্রমণের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫২.৪ বিলিয়ন ডলার দেয়- যার পুরোটাই মার্কিন সৈন্য ও সরকার লুফে নেয়।
যার কারণে আজকের প্রবন্ধ তা হচ্ছে মার্কিনির ‘আবু গ্রব’ (আবু গরিব) বন্দীশালায় ইরাকবাসীর উপর পাশবিক অত্যাচার করে। সেই অত্যাচার ও বর্বরতার অভিযোগ বরাবরই মার্কিন প্রশাসন অস্বীকার করে এসেছে। আবু গরিব বন্দীশালা বাগদাদের ৩২ কি.মি পশ্চিমে ২০০ একর জমিতে অবস্থিত। সাদ্দাম আমলে ৫০ হাজার বিরুদ্ধ বাদীদের এই বন্দীশালায় রাখা হয়।
সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করার পর মার্কিনিরা এখানে সন্দেহভাজন ইরাকিদের বন্দী করে রাখে। মার্কিনিরা ইসলাম বিদ্বেষ প্রসূত ধারণায় বহু নিরীহ মানুষকে এখানে বন্দী করে অমানবিক অত্যাচার করে। মানুষগুলোকে ন্যাংটা করে যৌন উদ্দীপক পজিশন করে পিরামিডের আকারে স্তূপ বানানো হত। গলায় দড়ি বেঁধে কুকুরের সাথে একত্রে মেঝেতে টানা হেচড়া করত। অনেককে পানির বদলে পেশাব খাইতে দিত। হেন কোন বর্বর আচরণ নেই যা এই আবু গরিব জেলে মার্কিনিরা করেনি। প্রথম মার্কিন CBS News 2008 এপ্রিলে এই বর্বরতার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়।
রেডক্রস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট ওয়াচ এর দাবির প্রেক্ষিতে U.S সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যবহারকে যুদ্ধাপরাধরূপে গণ্য করার নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে কিউবার গুয়ানতানামোতে মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান থেকে মুসলিম তরুণদের অত্যাচার ও বর্বরতার কাহিনী ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ওয়ানতানামোর বন্দীদের সরিয়ে নেয় বিভিন্ন স্থানে।
কিন্তু আবু গরিব জেলের বর্বরতার জন্য দায়ী ১৭ জন সৈন্য ও অফিসারকে ‘আই-ওয়াশ’ বিচার করে। দাম্ভিক মার্কিন প্রশাসন ইরাকি বন্দীদের বর্বরতম অত্যাচার সম্বন্ধে ‘এটা জিজ্ঞাসাবাদের (Interrogation) টেকনিক বলে সাফাই গায়, যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কারপিনসকি ইরাকিদের উপর যৌন-অশালীনতা সহ বর্বরতা অনুমোদন করেছিল তার শাস্তি হয় মাত্র কর্নেল পদে পদাবনতি, ৩ জন সৈন্যের দশ বছর জেল হয়, বাকিদের পেনশন বেনিফিট কর্তন করা হয় মাত্র। এই হচ্ছে মার্কিন মানবাধিকার এর স্বরূপ। আমাদের দেশে ‘রক্তের দোষ’ বলে একটা কথা আছে, ব্রিটিশরা বলে Sins of Flesh. যে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসে মার্কিন রাষ্ট্রের উদ্ভব তাতে আসলে জুলুম, অন্যায় ও পাশবিকতা ছাড়া আর কি হতে পারে। মার্কিন মুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ নেতা লুই ফারকান CNN-এর সাথে এক সাক্ষাতকারে নাইজেরিয়ায় দুর্নীতি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন- দুর্নীতি কোথায় নেই? নাইজেরিয়া কোন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করেনি। কিন্তু আমেরিকা বিশ্বব্যাপী অন্যায় হত্যার যজ্ঞ খেলেছে। যে অন্যায় লোভ ও অন্যায় অস্ত্র ও তেল ব্যবসার সিন্ডিকেট মার্কিন রাজনীতি কন্ট্রোল করেছে তার থেকে মুক্ত হওয়া মার্কিন সুনাগরিকদের পক্ষে দিন দিন কঠিন হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক







