প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কবিতার ছন্দে দাগ কাটে কামিনী রায়ের স্বরহীন নাম। স্বর বলছি, কামিনী রায়কে একদা নারী ভাবতাম বলে। ভীষণ লজ্জা হলেও, এতে এক বিন্দু দোষ নেই। আদিকাল থেকেই তো আমরা নারীর নির্দিষ্ট অবয়বে অভ্যস্থ। যুগে যুগে খুব কমই এর বৈরী আবহে ধরা দিয়েছে।
এরপর ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’র সূত্রে চোখে আসে ভাস্কর শামীম সিকদারের নাম। ন্যাড়া বেল তলায় কয়বার যায়? শামীম শিকদার, নামটাতে কেমন পুরুষ ভাব। যে কয়েক টুকরো ছবি–তাতেও তিনি প্যান্ট শার্ট পরা, ঘাড় অব্দি চুল, সিগারেট ফুঁকে কাজ করে চলেছেন।
অনেকদিন যাবত পুরুষের চোখে নারীকে দেখার দৃষ্টি, এর বেশি ভাবতে দেয়নি। চোখের ধূলো সরাতে হলো, শামীম শিকদারের মৃত্যুতে। গত ২১ মার্চ তাঁর মহাপ্রয়াণে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই পাঠ। ১৯৫৩ সনে জন্ম শামীম শিকদারের। সনটা কতটা ঠিক, বলা মুশকিল। কেননা শামীম শিকদার নিয়ে এখন অব্দি
কোনো বই, তথ্য–সংকলন, একক কিছুই চোখে পড়েনি। এর বাইরে টুকরো যা কিছু পাওয়া যায়, তাতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিশ্লেষণ দ্বিধান্বিতই করে।
ব্রোঞ্জ, কাঠ, প্লাস্টার অব প্যারিস, কাগজ, স্টিল, গ্লাস ফাইবারসহ বেশিরভাগ মাধ্যমে কাজ করা শামীম শিকদার পড়েছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও লন্ডনে। ঢাকা চারুকলায় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৯৮০ সনে। ভাস্কর শামীম শিকদার ২০০১ সালের আগ অব্দি তাঁর কর্মে জাগ্রত রেখেছেন
নিশ্চিত। বিখ্যাত কর্মের তালিকায় আছে, ১৯৮৮ সনে নির্মিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’, ১৯৯৪ সালে নির্মিত স্বামী বিবেকানন্দ’র ভাস্কর্য, ১৯৮২ সালের ‘স্ট্রাগলিং ফোর্স’, ১৯৮৩ সালে ‘মধুর ভাস্কর্য’ ইত্যাদি। চারুকলা ইন্সটিটিউটের নিবেদিত প্রাণ শামীম শিকদারের করা জয়নুলের ভাস্কর্য কেন পলিথিন দিয়ে মোড়ানো, এ
যেন এক আশ্চর্যের বিষয়। প্রশ্নের উদগ্রিব করে, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার এত অব্যর্থ প্রচেষ্টা কেন?
চারুকলায় শামীম শিকদার নিজেই গাড়ি চালিয়ে যেতেন, পকেটে রাখতেন পিস্তল। বিপ্লবী সিরাজ শিকদার ছিলেন, তার আপন ভাই। নিজের ভাইয়ের হত্যার পর চারুকলায় বেশ সময় পিস্তল পকেটে করে চলাফেরা করতেন বলে জানা যায়। শামীম শিকদারের পিস্তল থাকাটা বাঙালি বাঁকা চোখে দেখার কারণ নিশ্চয়
নারীত্বে বাধ সাধে। নারীদের যে আদি চিহ্ন কোমরে চাবির ছড়া, সেখানে পিস্তল পকেটে তাও আবার শিল্পী, বোধ করি আমাদের কষ্টই হলো হজমে। তৎকালীন সময়ে ভাস্কর্য নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা যতটা না নড়বড়ে তার বিপরীতে নারী ভাস্করকে দেখতে পাওয়া ও সমানে নানান মাধ্যমে এতখানেক ভাস্কর্য তৈরি শামীম শিকদারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আপ্লুতবোধ হয়।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষ হতে শিল্পকর্মের সম্মানী স্বরূপ ১০ হাজার টাকার রাষ্ট্রীয় সম্মান, ২০০০ সনে একুশে পদক প্রাপ্তি, পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে শামীম শিকদারের দেশ ত্যাগ নিয়ে জলঘোলা করার কোনো কারণ নেই। শামীম শিকদার নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয় বহন
করেননি। এছাড়া নিজের ইচ্ছায় চলা স্বাধীন এ–ভাস্করের পক্ষে দেশে না থাকতে পারাটাই স্বাভাবিক ছিলো। সেসময়ের আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া জটিলই। তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিচারণে জানা যায়, তিনি শামীম শিকদারের ঘরেই ১৯৯৪ সালের সময়তে আত্মগোপনে ছিলেন। ঘরবন্দী থেকে, হন্যে হয়ে
খোঁজা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে দু’জনে মিলে ক্যানভাসে হাত দিয়েছিলেন। দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তসলিমা নাসরিনও। ফলত সে সময়ের গল্প অজানা নয় কারো।
ভাস্কর্য নিয়ে আলাপে কেন সকলে শামীম শিকদারকে খারিজ করেন, তা জানার ইচ্ছে না থাকাই ভালো। বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী ভাস্করের নাম ফলত আলাদা করে আওড়াতে হয়। ‘নভেরা’, ‘ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’, ‘শামীম শিকদার’ একক নাম হয়ে উঠেন ইতিহাসে, কর্মে–মননে। শামীম শিকদারের ক্ষেত্রে
কাজের সমালোচনার চেয়েও তাঁর বাহ্যিক গড়নে সকলের চোখ ছিলো বেশি। তাঁর দৃঢ় কণ্ঠ, গতানুগতিক নিয়মকে ভেঙে এগিয়ে চলা, এক প্রকার ডেসপারেট লেডিই লোকের আলোচনার বস্তু ছিলো। আদতে এর বেশি বাংলার জনতা ভাবতে পারে না। ফলে সাদা জমিনে তাঁর শিল্পকর্মকে ঢেকে দিয়ে নোংরা রাজনীতির
শিকার তাকে হতে হয়েছে। কিন্তু এতে কিছু আসলো–গেলো না। নারীর শক্ত অবস্থান, স্বাধীনতা, মুক্তি, প্রথা ভেঙে এগিয়ে চলাতে শামীম শিকদার ছিলেন অনড়।
যত বেশি কাজ করেছেন, তার চেয়ে বেশি রটে গেছে তাঁর নাম। কুখ্যাতিতেই বেশি। যে নারী ঘরে কাঠ জ্বালিয়ে চুলা ধরালেন না, ভাস্কর্য বানালেন সে সকলের চোখের বালি হয়ে উঠলেন। উনুনে ফুঁ না দিয়ে, হয়ে উঠলেন চেইন স্মোকার। তবে সংসারধর্মকে একবারে গ্রহণ করেননি তা নয়। দুই কন্যা সমেত নিজস্ব সংসার গুছিয়েছেন।
‘না’ বলা পৃথিবীর দুর্বোধ্য কাজের মধ্যে একটি, আর নারী থেকে ‘না’ শোনার অভ্যাসে এখনো পাকা নই আমরা। বিশিষ্ট চিন্তক আহমদ ছফার গ্রন্থ ‘অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী’র দুর্দানা সেই শামীম শিকদারই। সেসময়ে আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমদের সাথে শামীম শিকদারের পরিচয়–আড্ডা ছিলো নিবিড়।
আহমদ ছফাও শামীম শিকদারের প্রেমে পড়েছিলেন, চেয়েছিলেন বিয়ে করতে। ছফার স্বভাবে অবগত শামীম শিকদারও সহজে ‘না’ বলে দেন। তাঁর অনাগ্রহই পরবর্তীতে নানাবিধ ইতিহাসের জন্ম দেয়।
শামীম শিকদার দেশে ফিরেছেন কবে, তা নিয়ে আমাদের জানা নেই। তবে যে দেশ কুখ্যাতি, অসম্মান ছাড়া আর কিছু দেয়নি, সে দেশে ফিরেছেন তাও স্বাধীনতার মাসে। সব যেন কাকতালীয় ঘটনা। নিজের শেষ নিঃশ্বাস ফেলে, আমাদের সকলের মন ভারী করতেই বোধ হয় দেশে এসেছিলেন ভাস্কর শামীম
শিকদার। চারুকলা থেকে কিংবা এ দেশ থেকে তার কি পাওনা ছিলো তার দরকষা এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শামীম শিকদার এসবের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক আগেই নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন। যারা তার কর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে রাজনীতি খুঁজেন তাদের জন্যে দুঃখ হয়ে বটে। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করেও
শামীম শিকদারের নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। কেবল ভাস্কর্যের ইতিহাসে নয়, নারীবাদী অগ্রণী হিসেবেও চিহ্ন রেখেছেন যিনি তার প্রয়াণে জানাই শ্রদ্ধা।