ভাষা বিজ্ঞানী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান : কিছু স্মৃতি

ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া | বুধবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সম্প্রতি পরলোক গমন করেছেন। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। মনে পড়ছে ১৯৭২ সালের শেষের দিকের কথা। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়তে আসি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার ফলাফলের পর আমাদের কয়েকজন হোস্টেল বন্ধু সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবো। আমি আমার বড় মামার কাছে (মায়ের সাথে মামা বাড়ি যাবার পর) যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি তিনি তখন মনিরুজ্জামান স্যারের কাছে একটি চিঠি লিখেন। চিঠির মাধ্যমে মনিরুজ্জামান স্যারকে অনুরোধ করেন আমাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য। চিঠিটি সযতনে নিয়ে আমি চট্টগ্রামে আসি। ভর্তি পরীক্ষার ফাঁকে একদিন বাংলা বিভাগে যাই এবং অফিসে স্যারের কথা জিজ্ঞেস করি। কর্মকর্তা আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন কোন মনিরুজ্জামান স্যার? বিভাগে তো দুইজন মনিরুজ্জামান আছেন। আমি এর কোন উত্তর দিতে না পেরে চিঠি ফেরৎ নিয়ে আসি। অনেক পরে জানতে পারি যে অধ্যাপক হায়াত মামুদের (পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান) সার্টিফিকেট নাম হলো মনিরুজ্জামান। যা হোক ঘটনার ওখানেই ইতি ঘটে। ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই এবং সাবসিডিয়ারি হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নেই। বাংলা বিভাগে সাবসিডিয়ারি বিষয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন খালেদা হানুম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হায়াত মামুদ, রাজিয়া সুলতানা, মনিরুজ্জামান প্রমুখ। তখনও আমি বুঝতে পারছি না মামা কাকে চিঠি লিখেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। এরপর শিক্ষক রাজনীতির সাথে ক্রমশ জড়িয়ে যাই এবং দু এক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের সাথে পরিচিত হই। যা হোক এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে মনিরুজ্জামান স্যারকে আমার মামার পরিচয় দিয়ে কথা বলি। তখন তিনি সহজেই মামাকে চিনতে পারেন। মামা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সেই ১৯৩০ সালের গ্রাজুয়েট। ঘটনা হলো যে মামা নরসিংদী আদিয়াবাদে (মনিরুজ্জামান স্যারের গ্রাম) প্রাথমিক কর্মজীবনে শিক্ষকতা করেছিলেন এবং মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে পরিচিত ছিলেন। আমার মামার বাড়ি ছিল কুমিল্লার হোমনা থানায় এবং মেঘনা পেড়িয়ে গেলেই নরসিংদী যাওয়া যেত সে সময়ে। সেই থেকে মনিরুজ্জামান স্যার একজন প্রিয় চরিত্র হিসেবে আমার মনে স্থান করে নেন।

১৯৮০ এর দশকে ভারতে পিএইচ.ডি করার জন্য মনিরুজ্জামান স্যার শিক্ষা ছুটি নিয়ে চলে যান। বলাবাহুল্য যে ভাষাতত্ত্বের উপর গবেষণা করার জন্যই তিনি গিয়েছিলেন। তাঁর মনটি ছিল শিশুর মতোই কোমল। থিসিস জমা দিয়ে তিনি বাংলা বিভাগে ফিরে আসেন এবং একাডেমিক দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। কিন্তু তিনি প্রায়ই আনমনা অথবা চিন্তাযুক্ত ছিলেন। তাঁর পিএইচ.ডি থিসিস মূল্যায়নের পর যে ভাইভা হবে তার ডাক তিনি পাচ্ছেন না। তাই এই নিয়ে মানসিক উৎকন্ঠা। এক পর্যায়ে তাঁর পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করা হয়। মৃদুভাষী ও সদাচার ছিল তাঁর ভূষণ। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব (ক্যাম্পাস) এর নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন সভাপতি ও আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। অবশ্য মনিরুজ্জামান স্যার ছয় মাসের ছুটি গ্রহণ করে দেশের বাইরে গবেষণার জন্য চলে যান। ফিরে আসলেও তিনি আর দায়িত্ব নেননি। তাঁর জীবনের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল তাঁর একমাত্র কন্যা ‘দোলা’র মৃত্যু। দক্ষিণ ক্যাম্পাস (চবি) এর বাসা থেকে বের হয়ে দোলা যখন কলেজ বাসে চড়ে এবং একটি কাজে দ্রুত নামতে যায় তখনই বাস তাকে আঘাত করে এবং মারা যায়। ‘দোলা’র নামে এখন সড়কটির নামকরণ রয়েছে। ১৯৯৬১৯৯৮ সময়ে ছিলেন কলা অনুষদের নির্বাচিত ডিন। সে সময়ে ভর্তি পরীক্ষা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নেয়া হতো না। উত্তরপত্র মূল্যায়ন, নীরিক্ষা, টেবুলেশন ইত্যাদি ডিন অফিসে করা হতো এবং মনোনীত শিক্ষকদের মাধ্যমে বেশ কয়েকদিন প্রচন্ড শ্রম দিয়ে কাজ শেষ করা হতো। মনিরুজ্জামান স্যারকে সকল শিক্ষকই আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন হাসিন জাহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আব্দুল হাই ছিলেন হাসিন জাহানের পিতা। ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত নীপবন শিশু বিদ্যালয়ের শুরু থেকেই তিনি অধ্যক্ষ্যা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

. মনিরুজ্জামান বরাবরই আমাদের সাথে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছিলেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ঢাকা স্থিত হন। মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হতো। ২০২১ সালে করোনাকালে মুহম্মদ আব্দুল হাই জন্মশতবার্ষিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউট পালন করার উদ্যোগ নেয়। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য। আমি মুহম্মদ আব্দুল হাই এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ এর উপর একটি আলোচনা লিখে পাঠিয়ে দেই। তিনি খুব খুশি হন তাঁর অনুরোধ অনুযায়ী লেখা পাঠানোর জন্য। পরবর্তী সময়ে সবগুলো লেখার একটি সংকলন প্রকাশ করার প্রক্রিয়া রয়েছে বলে জানান।

২০২২ সালে স্যারের সাথে সর্বশেষ দেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের নিচ তলায়। আমি পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি কাজ সম্পাদন করে বের হচ্ছিলাম। সে সময়ে স্যার কথা বলার মাঝখানে তাঁর প্রাণঘাতি অসুখের কথা জানালেন। আমি তাঁকে অন্য কথার প্রসঙ্গ টেনে তাঁর মনযোগ সরিয়ে নিলাম। মাত্রই কয়েকমাস আগে ফোন করে আমার ইমেইল ঠিকানা নিলেন এবং তাঁর একটি লেখা পাঠালেন। নরসিংদীর আদিয়াবাদ এ ছিল তাঁর জন্মস্থান। সেই স্থানটি ঘিরে তাঁর যে স্বপ্ন ছিল তা তাঁর ছেলে প্রমি (শামিমুজ্জামান) বাস্তবায়িত করবে এমন প্রত্যাশা ছিল তাঁর। ড. মনিরুজ্জামান নেই এমন সংবাদটি আমাকে এখনও মাঝে মাঝে দুঃখভারাক্রান্ত করে দেয়। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ জীবন প্রত্যাশা করি। ড. মনিরুজ্জামান তাঁর গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে জ্ঞানজগতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : প্রাক্তন উপাচার্য, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; প্রাক্তন ডিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; প্রাক্তন অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ