‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়/ ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে পারেনি। কারণ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে কেঁপে ওঠে রাজপথ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা রক্ষায় বুকের তাজা রক্ত দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ ভাষাশহীদরা। তাদের এই ত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের জীবনের বিনিময়ে বাঙালি পেয়েছে বাংলায় কথা বলার অধিকার। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। এরপরও সেদিনের কথা বাঙালি কখনো ভুলবে না। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’।
বাঙালি জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে জন্ম নেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। তাই ভাষা আন্দোলনের নানা ঘটনাপ্রবাহ স্থান করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। গল্প, ছড়া, কবিতা, কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধে নানাভাবে স্থান করে নিয়েছে ভাষা আন্দোলন। পাঠকেরও সমান আগ্রহ রয়েছে বাঙালির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায় নিয়ে। তবে গত কয়েক বছরে ভাষা ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব কম। এবার বইমেলা উপলক্ষেও হাতেগোনা বই বেরিয়েছে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ আছে পাঠকের।
তারা বলছেন, ভাষার মাসে আয়োজন করা হয় বইমেলা। আবার বলা হয় অমর একুশে বইমেলা। অথচ এ একুশই কেমন জানি অবহেলিত লেখক–প্রকাশকদের কাছে। তা না হলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম থাকবে কেন?
নগরের সিআরবি শিরীষতলায় চলছে বইমেলা। গত কয়েকদিন ধরে মেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশকদের প্রায় প্রতিটি স্টল ঘুরে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে বই খুঁজতে গিয়ে অনেকটা হতাশ হতে হয়েছে। কারণ হাতেগোনা কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগই ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে বই প্রকাশ করেননি। কয়েকটি স্টলে অবশ্য পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থ দেখা গেছে। অনেকে অন্য সংস্থা থেকে পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থের নতুন সংস্করণ বের করেছেন। তবে মেলায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই খুঁজতে দেখা গেছে অনেক পাঠককে। গতকাল মেলায় কথা হয় ছড়াকার আ ফ ম মোদাচ্ছের আলীর সঙ্গে। তিনি আজাদীকে বলেন, এই বইমেলাকে বলা হয় একুশে বইমেলা। এই মেলায় আবার একুশ ফেব্রুয়ারি নিয়ে বই–পুস্তক কম, সেটা উদ্বেগের বিষয়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরো বই বের হওয়া উচিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বইপুস্তক কম থাকলে আমাদের বাচ্চাদের জানার পরিধি তো বাড়বে না। এক্ষেত্রে গবেষক ও লেখকদের আরো সচেতন হওয়া উচিত এবং এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। প্রকাশকদেরও আন্তরিকতা প্রয়োজন।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সোয়াইব আহমেদ আজাদীকে বলেন, আমার মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার বই পড়ার অভ্যাস আছে। তাকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে রচিত বই পড়তে উৎসাহ দিই। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখি, সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে কিনা। এরই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে সহজ ভাষায় লেখা বই খুঁজছি। খুব বেশি পাইনি। অনেক খুঁজে মাহবুবুল হকের ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’ বইটি কিনলাম মেয়ের জন্য।
পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স লি. এর প্রতিনিধি ইফতি আজাদীকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতহাস নিয়ে হয়তো কমবেশি সবাই জানেন, যেহেতু বিষয়টা একাডেমিকভাবে পড়ানো হয়। পাঠ্যপুস্তকে পড়তে হয় বলেই হয়তো বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি করে না। ভাষা আন্দোলনের বই কম চলে।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে এবার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডা. মাহফুজুর রহমানের ‘ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু’, মো. কামরুল হাছান ও অজয় কৃষ্ণ গোমস্ত সম্পাদিত ‘বায়ান্ন থেকে বিজয়’, বদরুদ্দীন উমরের ‘আমাদের ভাষার লড়াই’, ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড)। এছাড়া পাঠকের পছন্দের তালিকায় আছে মর্তুজা বশিরের ‘একুশের লেখা, একুশের আঁকা’, মোস্তাক আহমাদের ‘ভাষা আন্দোলন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি’, অরবিন্দ মিত্রের ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ জিজ্ঞাসা’, আহমেদ রিয়াজ সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১’, ড. মাহবুবুল হকের ‘গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন’, ইলু ইলিয়াসের ‘একুশের পটভূমি ও সাহিত্যরূপ’ ও এমরান চৌধুরী সম্পাদিত ‘ছড়া–কবিতায় একুশ’। হাফিজ রশিদ খানের ‘আদিবাসিতার ঝরনাতলায়’ এবং শামসুদ্দিন শিশিরের লেখা ‘পার্বত্য জনজাতির ভাষা–সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ বইটিও পাঠকের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
এর মধ্যে বদরুদ্দীন উমরের ‘আমাদের ভাষার লড়াই’ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে শিশু–কিশোরদের কৌতূহল মেটাতে পারবে। ‘সহজ ভাষায় লেখা বদরুদ্দীন উমরের আমাদের ভাষার লড়াই। শিশু–কিশোরদের জন্য লেখা হলেও বইটি সবাই পড়তে পারবেন আনন্দের সঙ্গে।’
ডা. মাহফুজুর রহমান ‘ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে ‘তথ্য–উপাত্ত ও দালিলিক যুক্তি উপস্থাপন করে স্পষ্ট করেছেন, ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে বিভিন্ন পথ ও মতের একগুচ্ছ মানুষদের মধ্যে বড় অংশই ভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ধারার বিপরীত স্রোতেই থেকেই গেছেন। কেউ কেউ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, আবার কেউ কেউ তীর হারা তরীর মতো নানা ঘাটে ছুটেও স্থায়ী ঠাঁই পাননি।
‘পার্বত্য অঞ্চলে এগারোটিসহ আরও কয়েকটি আদিবাসী জাতির বৈচিত্র্যময় ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এই জাতিগুলোর বহুলচর্চিত প্রাচীন ভাষাগুলো তাঁদের জীবনধারার সকল আচরিত ও চিন্ময় আবেগ–অনুভূতি ধারণ ও প্রকাশে সুসক্ষম। জনধারা, ধর্মবিশ্বাস ও ভাষার স্বতন্ত্রতার দিক থেকে তাঁরা সমতলী বৃহত্তর বাংলা ভাষাভাষী থেকে আলাদা হলেও রাষ্ট্রিক পরিচয়ে বাংলাদেশের অধিবাসী এবং এদেশেরই ধূলোয় গড়া সন্তান। এখানে বসবাসরত আদিবাসী জাতি ও বাঙালি সমাজের এতদিন আড়ালে থাকা মেধা–মনন ও সৃজনশীলতার দিকটি কিছুটা হলেও উৎকলনের চেষ্টা আছে হাফিজ রশিদ খানের ‘আদিবাসিতার ঝরনাতলায়’ গ্রন্থে।
চাটগাঁ উৎসব : বইমেলা মঞ্চে গতকাল অনুষ্ঠিত হয় চাটগাঁ উৎসব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। মুখ্য আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন কবি কামরুল হাসান বাদল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু। বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক ড. আজাদ বুলবুল ও সাংবাদিক আলমগীর অপু।