গত বছর বিভাগীয় প্রশিক্ষণ –এ বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি, কোটবাড়ি কুমিল্লায় যাই। সিদ্ধান্ত নিলাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যাব। যেই কথা সেই কাজ। ডাইনোসর পার্ক থেকে সোজা চলে গেলাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। যত ভেতরে যাচ্ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নান্দনিক স্থাপনা দেখে। তবে সব ছাপিয়ে একটা দৃশ্য মনের মধ্যে দাগ কাটলো। সেখানে একটি হলের নাম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছবি দেখেই ভাষা আন্দোলনের কথা মনের মধ্যে জেগে উঠল। ভাষার জন্য প্রথম তিনিই প্রতিবাদ করেছিলেন এমনটা শুনেছি অনেকের কাছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে কিছু লিখব। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম। কিছু বই সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করলাম।
ভাষার মাস এলেই যেন বাঙালির রক্ত টগবগিয়ে উঠে দুঃখ সুখের এক মিশ্র অনুভূতিতে। একদিকে ভাই হারানোর মর্মবেদনা,অন্য দিকে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়। আমরা সেই জাতি যাদেরকে মায়ের ভাষায় কথা বলার স্বীকৃতি পেতে জীবন দিতে হয়েছে রাজপথে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। তখন থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফোরামে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এদেশের ভাষাবিদ ও ভাষা সৈনিকগণ। ভাষার জন্য সর্বপ্রথম যিনি প্রতিবাদ করেন তিনি হলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা) জেলার রামরাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগবন্ধু দত্ত। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বি এল। তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি নবীনগর হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, কুমিল্লা কলেজ থেকে এফ এ এবং কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি এ পাস করেন। তিনি মুরাদনগর থানার সুরবালা দাসকে বিয়ে করেন। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গুরা উমালোচন হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯১১ সালে কুমিল্লা জেলা বারে যোগদান করেন আইন ব্যবসায়ী হিসেবে। ১৯০৭ সালে কুমিল্লা হিতসাধন সভার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। কুমিল্লার সুপরিচিত অভয় আশ্রমের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল এর রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যাবস্থাপক সবার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে যোগ দিয়েছিলেন ভারত ছাড় আন্দোলনে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন। কংগ্রেসের টিকিটে ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যাবস্থাপক সবার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দু র পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, পাকিস্তানের পুর্ব পাকিস্তান এ জনসংখ্যা সংখ্যা গরিষ্ঠ এবং বাঙালি,তাই বাংলা কে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কিন্তু লিয়াকত আলী খান এ দাবি নাকচ করে দেন। প্রকৃত পক্ষে ১৯৪৮ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত হয়। গণপরিষদের অধিবেশর শুরুতে আলোচনা সূত্রপাত করেন পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ নাথ দত্ত। তিনি বলেন— president sir I move ; “ that is sub- rule (1)of rule 29 after the word English in line 2 , the word or Bengaline inserted”. আলোচনার এক পর্যায়ে গণপরিষদ নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ প্রস্তাবটিকে নির্দোষ ভেবেছিলেন। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবের পর তিনি এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের শিকার আভাস পেলেন, যা পরবর্তীতে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করবে, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে দেবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দৃঢ় আস্থার সাথে ঘোষণা করছিলেন
“Pakistan has come to stay” . কিন্তু ২৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বাঙালি প্রমাণ করেছে যে “has come be decided” . মূলত এর পেছনে কাজ করেছিল ১৯৪৮ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারির গণপরিষদে ব্যবহার্য্য ভাষা বিষয়ক আলোচনা। এর জন্য আমাদেরকে ভাসতে হয়েছিল রক্তগঙ্গায়। এই রক্ত গঙ্গার অন্যতম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আরো বলেছিলেন বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা হলেও সমগ্র পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাই ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা সমর্থনযোগ্য নয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আরো বলেছিলেন গণপরিষদে যে ভাষায় বিতর্ক হচ্ছে তা সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের বোধগম্য নয়। ভাষা সম্পর্কিত একটি নির্দোষ সংশোধন আলোচনা যে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পর্যবসিত হয় তার প্রমাণ পেয়েছি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও লিয়াকত আলী খান এর তর্ক যুদ্ধে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন “So, Sir I Know I am voicing the sentiments of the vast million of our state and therefore Bengali should not be treated as provincial language.It should be the language of the state. সেই দাবি ই ঘোষণা দেয় রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। সেই দাবি প্রাণ পায় চার বছর পর ১৯৫২ সালে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে গণপরিষদে ভাষা বিতর্কে শেষ বাক্যটি ছিল “The motion was negative” কিন্তু সেই Negative একদিন Positive হয়ে উঠেছিল। গণপরিষদের অধিবেশন থেকে পূর্ব বাংলার সংসদ সদস্যরা যখন ঢাকায় ফিরেন তখন বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০/৫০ জন ছাত্র ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেই থেকে শুরু। এরপর ১১ মার্চ ১৯৪৮ পূর্ব বাংলায় ভাষা দিবস পালিত হয়। ওই বছর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন–“Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan” তখন মিটিং এ ছাত্ররা ‘না না…’ ধ্বনিতে প্রতিবাদ করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ কিংবা ১৯৫২সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হননি। নিখোঁজ হয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। কিছু সূত্র থেকে জানা যায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শহীদ হন ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এ কি অমানুষিক–অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তা জানা যায় ক্যান্টনমেন্ট এর নাপিত রমনী মোহন শীলের কাছ থেকে। রমনী মোহন শীলকে বাঁচিয়ে রাখা হয়ছিল পাকিস্তান সেনাদের চুল দাড়ি কাটার জন্য। সাখাওয়াত আলী খান প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়। ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমনী শীলের চোখের জল বাঁধ মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন ্ত্ত “আমার যে পাপের ক্ষমা নেই,বাবু স্কুল ঘরের বারান্দায় হামাগুড়ি দিয় আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙুল দিয়ে ইশারা দিয়ে তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দেই। তখন তিনি অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটা পা ধরে উঠানে নামেন। তখন আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বারবার বাবুর দিকে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলছিল এটি একটা দেখার জিনিস নয়। তুমি তোমার কাজ কর।” এরপর বাবুর দিকে তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে ভাবলাম বাবু জনগণের নেতা ছিলেন। আজ এ অবস্থা। তার সমস্ত ক্ষতবিক্ষত দেহে তুলা লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপুরি কয়েক দিন ই ব্রিগেড অফিসে আসতে দেখি ।” ১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব বাংলার গভর্নর শাসনের বিরুদ্ধে একটা ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আতাউর রহমান খানের মন্ত্রীসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে গৃহবন্দি করা হয়। তা সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালি নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এডভোকেট আব্দুল করিমের নেতৃত্বে তার ছোট ছেলে দিলীপ কুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং ময়নামতি সেনানিবাসে নির্যাতন করে মারা হয়।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার দাবি জানিয়ে যে সাহস দেখিয়েছিলেন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী তা মনে রেখেছিল। তার দুঃসাহসিক ভূমিকাই যে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল তা স্পষ্ট এবং প্রমাণিত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই অবদান আমরা কোনদিন ভুলতে পারি না এবং এ বিষয়ে তাঁর নাম আসবে সবার আগে নিঃসন্দেহে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৭ সালে ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে “শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল” নামে একটা আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে “ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম।” কুমিল্লা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে রাস্তার নামকরণ করে যেটা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে শহীদখাজা নাজিমুদ্দিন সড়ক পর্যন্ত। ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে তাঁর নামে একটি লাইব্রেরি করা হয়। তবে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এসবই খুব সামান্য।