ভালো ফলাফল করেও প্রয়োজনীয় সুযোগ–সুবিধা, সামাজিক সচেতনতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং আর্থিক দীনতাসহ নানা কারণে দেশের নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সুযোগ–সুবিধা সৃষ্টি করা সম্ভব না হওয়ার পাশাপাশি সচেতনতার অভাবে দেশের অর্ধেক নারী শিক্ষার্থীকে ঝরে পড়তে হচ্ছে। এসএসসি এবং এইচএসসির সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের অগ্রযাত্রা চোখে পড়ার মতো হলেও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পারিবারিক সচেতনতা নারীদের ঝরে পড়া রোধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপবৃত্তিসহ সরকারের নানা উদ্যোগ, পৃষ্ঠপোষকতা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ–সুবিধা বাড়ার কারণে স্কুল–কলেজে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশানুরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা ক্রমে ঝরে পড়ছে। চাকরির ক্ষেত্রেও নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শিক্ষাজীবন শেষ করতে না পারা এটার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে নারী শিক্ষার্থীরা পুরুষ শিক্ষার্থীর চেয়ে এগিয়ে আছে। মেধার দিকেও তারা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে থাকে বিভিন্ন বিভাগে। জিপিএ–৫ পেয়ে পাস করা ছাত্রীর সংখ্যাও ছাত্রদের তুলনায় বেশি। কিন্তু এতগুলো সূচকে এগিয়ে থাকলেও পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের ঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে চাকরি এবং উচ্চ শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের হতাশাজনক চিত্র উঠে আসছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল একাধিক অভিভাবক এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, স্কুল এবং কলেজ জীবন শেষ করার সাথে সাথে অনেক মেধাবী ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে পরিবার শেষ রক্ষা করতে চায়। স্কুল–কলেজের গণ্ডি পার হওয়ার আগে বড় একটি সংখ্যার ছাত্রীকে সংসারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাদের যত মেধাই থাকুক না কেন তারা আর লেখাপড়ার মূল স্রোতে থাকে না। ছিটকে পড়ে। অধিকাংশ পরিবার কন্যা সন্তানকে বেশি লেখাপড়া করাতে চায় না। এসএসসি বা এইচএসসি পাস করলে বিয়ে দিয়ে নিস্তার পেতে চায়। এই মানসিকতাই নারী শিক্ষার পথে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন তারা।
মেয়েদের একটি কলেজের একজন অধ্যাপক আজাদীকে বলেন, তাদের কলেজের অনেক মেধাবী মেয়ে এখন সংসারের ঘানি টানছে। অথচ তাদের অপার সম্ভাবনা ছিল।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীদের সমস্যায় পড়তে হয় বলে মনে করেন একজন অভিভাবক। তিনি বলেন, ছেলে সন্তানকে যেখানে খুশি পড়ানো যায়, কিন্তু মেয়েকে তো আর যেখানে সেখানে ছেড়ে দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হলে মেয়েকে বাড়ি থেকে বহু দূরে চলে যেতে হয়। সেখানে তার দেখভাল, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক অভিভাবক কন্যা সন্তানকে দূরে পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান না। মেধা থাকলেও তা আর বিকশিত হয় না।
এক অভিভাবক নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, মেয়েদের বয়স এবং শিক্ষা বেড়ে গেলে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয়। অনেক সময় মেয়ের চেয়ে কম শিক্ষিত ছেলের হাতে তাকে তুলে দিতে হয়।
এসব বিষয় নাকচ না করলেও নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষক বলেন, আসলে আমাদের মানসিকতার উন্নতি দরকার। জাতি হিসেবে এখনো আমরা মানসিকভাবে উন্নত হতে পারিনি। তাই নারী শিক্ষার্থীদের অগ্রযাত্রা নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
প্র্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা চোখে পড়ার মতো। বিনা বেতনে অধ্যয়ন, উপবৃত্তি কিংবা বিনা খরচে বই দেওয়ায় অনেক নারী লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের সমাজব্যবস্থা মূলত গ্রামীণ। বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গ্রামীণ জনপদে মেয়েদের অনেকটা অবরুদ্ধ করা হতো। হিন্দু–মুসলিম নির্বিশেষে মেয়েদের অবরুদ্ধ করার একটি প্রবণতা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বেগম রোকেয়ার দুটি বইয়ের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওইসব দিন পাল্টে গেছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে নারীরা স্কুল–কলেজে ব্যাপক হারে লেখাপড়া করছে এবং ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে তারা ছিটকে পড়ছে।
এজন্য আমাদের সামাজিক এবং মানসিক অবস্থাকে দায়ী করে তিনি বলেন, পরিবারের কন্যা সন্তানকে সংসার গড়িয়ে বাবা–মা নিশ্চিন্ত হতে চান। অনেকটা দায়মুক্তির মতো। তাই তাদের লেখাপড়ার মাঝপথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, অনেক দেশেই এমনটি হয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা পাইলট হচ্ছে, বিমান চালাচ্ছে, ট্রেন চালাচ্ছে, সৈন্য হয়ে অস্ত্র চালাচ্ছে। আগামী ৫০/৬০ বছরের মধ্যে আমাদের মেয়েরাও ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমানে সমানে পা চালাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রাখলে সমাজ কখনো এগোবে না। সরকার এই বিষয়টি অনুধাবন করেই নারী শিক্ষা এবং নারীদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করছে।