ভালোবাসায় সিক্ত ড. মাহবুবুল হক

বহুবিধ ও বিচিত্র কর্মের জীবন

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

৭৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শুভানুধ্যায়ী, পাঠক, ভক্ত ও অনুরাগীদের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. মাহবুবুল হক। গতকাল বিকালে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় আমন্ত্রিত অতিথি ও আলোচকরা তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। ড. মাহবুবুল হক সংবর্ধনা পরিষদের আহ্বায়ক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মফিদুল হক। আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক সভাপতি ড. মহীবুল আজিজ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম ও চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর রীতা দত্ত। স্বাগত বক্তব্য দেন ড. মাহবুবুল হক সংবর্ধনা পরিষদের সচিব কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ।

আবৃত্তিশিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম একাডেমির মহাপরিচালক প্রাবন্ধিক আমিনুর রশীদ কাদেরী, লেডিস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট খালেদা আউয়াল, বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান ও ড. মাহবুবুল হকের সহধর্মিনী সালেহা বেগম।

. অনুপম সেন বলেন, বাংলায় দুটি নবজাগরণ ঘটে। সর্বশেষ ৫০এর দশকে যে নবজাগরণ তার একটি বড় ধারা ছিল এদেশের মুক্তির স্বপ্ন। মাহবুবুল হকও মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেন, মাহবুবুল হকের অবদান নানা ক্ষেত্রে ছড়ানো আছে। আজকে যে সংবর্ধনা তা যথার্থ হয়েছে। আমরা চাই, তাঁর কর্মপ্রবাহ চলতে থাকুক।

তিনি বলেন, অধ্যাপক মাহবুবুল হকের ৭৫ বছরের যে জীবন, তা বহুবিধ ও বিচিত্র কর্মে আলোকিত। তার কৈশোর ও যৌবনে তিনি চট্টগ্রাম শহরে বাম রাজনীতির একজন অগ্রগণ্য কর্মী ও সংগঠক হিসেবে নিজের পরিচয়কে বিশেষভাবে তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি অধ্যাপনাকে কর্মজীবনের পাথেয় করেছেন। তিনি এখনো এই কর্মে সম্পূর্ণভাবে নিমগ্ন। গবেষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। পেয়েছেন স্বীকৃতি। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল তিন কবি সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য। এই তিন কবিই নিপীড়িতজনের কবি, তাঁর যৌবনের রাজনীতির ভালোবাসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই কবিরা বাংলার কাব্যক্ষেত্রে বিশেষ এক ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। পরম যত্নে মাহবুবুল হক তাদের কবিতার বৈশিষ্ট্য উদ্‌ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, . মাহবুবুল হক আমার প্রিয়ভাজনদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী। তাঁর ধৈর্য আছে, সহ্য করার ক্ষমতা আছে; আছে রসবোধ। সুন্দর করে কথা বলেন। ভদ্র, রুচিশীল আচরণের জন্য তিনি বিশিষ্ট। মিষ্টভাষী এই মানুষটার মধ্যে নানা সুন্দর ও অপূর্ব গুণের সমন্বয় ঘটেছে। সৃজনে, মননে সবসময় তিনি ক্রিয়াশীল। ঝঞ্ঝাটমুক্ত তাঁর পথচলা। শান্ত জীবনধারায় তিনি সচল। এক কথায় অনন্য ব্যক্তিত্ব ড. মাহবুবুল হক।

তিনি বলেন, মাহবুবুল হক একজন গবেষক, ভাষাবিদ ও অধ্যাপক হিসেবে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন অনেক আগেই। অধ্যাপনায় অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন দেশেবিদেশে। আমি দেখেছি তাঁর মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য আছে গভীর মমত্ববোধ। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততার গুণে তিনি আজ এ অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মেধার সঙ্গে সমন্বয় ঘটেছে শ্রমের। মাহবুব বর্তমানে অসুস্থ শরীর নিয়েও লেখালেখির কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি তাঁর সুস্থ ও দীর্ঘজীবন কামনা করছি।

গবেষক মফিদুল হক বলেন, বিএ অনার্স ও এমএ পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেননি মাহবুবুল হক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে সুযোগ তৈরি হলেও তা গ্রহণ করেননি। ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্য হয়েছে। পার্টি তখন আরো বিপ্লবের শিক্ষায় দিক্ষিত করার জন্য পার্টির স্কুলে এক বছরের কোর্স করার জন্য নানাভাবে তরুণদের প্রেরণ করে। সেখানে মাহবুব ভাইও ছিলেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সাফল্য বা ব্যক্তিগত সাফল্যের সোপান বেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তার চেয়ে সামষ্টিক চিন্তাটা বড় হয়ে ওঠে মাহবুব ভাইয়ের কাছে। আজ পর্যন্ত তিনি সেটা এত সুন্দরভাবে বহন করে চলেছেন এতে বিস্মিত হতে হয়।

তিনি বলেন, ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে ড. মাহবুবুল হক দুই বাংলায় সমাদৃত। তিনি একজন অদম্য মানুষ। তিনি পদাতিকের সাধক। জ্ঞানের অনুসন্ধানে তিনি আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সম্পৃক্ত থেকেছেন জাগরণী কর্মকাণ্ডে। তিনি আরো বলেন, দৈনিক আজাদীর ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ প্রকাশনায় ড. মাহবুবুল হকের মেধা ও শ্রম যুক্ত আছে। নজরুল তারিখ অভিধান ড. মাহবুবুল হকের একটি বড় কাজ। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু তারিখ অভিধানও করেছেন।

সংবর্ধিত অতিথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন, আমরা একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশে অনেক উন্নতি হচ্ছে। সেই উন্নতি হচ্ছে বস্তুগত উন্নতি। কিন্তু মনোজাগতিক উন্নতিতে আমরা পিছিয়ে আছি। তিনি বলেন, কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে একটি সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশ চতুর্থ বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

তিনি বলেন, সাহিত্যজীবনে পথচলায় সবসময় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে আজাদী। তিনি বলেন, নানা আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। শিক্ষকরা আমাদের রাজনীতি শেখাননি। তারা আমাদের জীবনবোধ শিখিয়েছিলেন। তারা আমাদের মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। তারা আমাদের দেশব্রতী ও বিশ্বব্রতী হওয়ার প্রেরণা দিয়েছিলেন। এই প্রেরণা আমি আজও বহন করে চলেছি।

কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মহীবুল আজিজ বলেন, কথাকলি নামে মাহবুব ভাইয়ের একটা লাইব্রেরি ছিল। এটা ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক ঠিকানা। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা বিভাগে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছেন মাহবুব ভাই। শুধু লেখাপড়া নয়, এর সঙ্গে প্রকাশনার মাধ্যমে, দেয়ালিকার মাধ্যমে অর্থাৎ সমন্বিতভাবে বাংলা বিভাগকে সাহিত্যের বিভাগ হিসেবে রূপান্তরে অবদান ছিল তাঁর।

শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম বলেন, মাহবুবুল হক যেন কঠিন একটা শপথ করেছিলেন। এ শপথটা ছিল শুভ ও সুন্দরের মাঝে পথচলা এবং সুন্দর ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর দেশপ্রেমের কথা আমরা সবাই জানি। ছাত্রজীবন থেকে তিনি সাহিত্যকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ছিলেন। তিনি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। ভাষার প্রতি মমত্ববোধ থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।

প্রফেসর রীতা দত্ত বলেন, আগাগোড়া প্রমিত ও পরিশীল একজন মানুষ মাহবুবুল হক। তিনি চট্টগ্রামের সম্পদ। চট্টগ্রামের ভাষার উন্নয়নে কাজ করেছেন তিনি।

শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ বলেন, . মাহবুবুল হক বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনে এক বিশিষ্ট নাম। লেখালেখি, সম্পাদনা, শিক্ষকতা ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তার প্রয়াস ও কৃতিত্ব তাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

প্রাবন্ধিক আমিনুর রশীদ কাদেরী বলেন, আলোকিত ব্যক্তিত্ব মাহবুবুল হক। তার ৭৫ বছর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করতে পেরে আমরা আনন্দিত।

খালেদা আউয়াল বলেন, সাহিত্যে মাহবুবুল হকের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আলোকিত মানুষ। আজকের দিনে প্রার্থনা, আরো অনেক বছর বেঁচে থেকে শিল্পসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করুক তিনি।

প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, জীবনে চলার পথে যে কয়জনকে আপাদমস্তক শ্রদ্ধা করতে হয় তার অন্যতম মাহবুবুল হক।

মাহবুবুল হক সংবর্ধনাগ্রন্থ : . মাহবুবুল হকের সংবর্ধনা উপলক্ষে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একটি প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে, ‘মাহবুবুল হক সংবর্ধনাগ্রন্থ’। সম্পাদনা করেছেন রাশেদ রউফ। সহযোগী সম্পাদক শাকিল আহমদ, নিজামুল ইসলাম সরফী ও ইসমাইল জসীম। অন্যটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে, ‘মাহবুবুল হক সম্মাননাগ্রন্থ’। সম্পাদনা করেছেন ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও ড. সৈয়দ আজিজুল হক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনেপালে শক্তিশালী ভূমিকম্প, নিহত ১৫৭
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রী আসবেন, তাই সংস্কার হচ্ছে মাতারবাড়ির ভাঙা সড়ক