নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি সংস্থার ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রতিবছর আশ্বাস দেন, জলাবদ্ধতা ‘সহনীয়’ থাকবে। কিন্তু ভারী বর্ষণ হলেই ডুবে যায় শহরের নিচু এলাকা। দুর্ভোগ বাড়ে নগরবাসীর। এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবারও অতি ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। অবশ্য চলতি মৌসুমে গতকালসহ এ পর্যন্ত পাঁচদিন জলজট ও জলাবদ্ধতায় অসহনীয় হয়ে ওঠে জনজীবন।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দিবাগত মধ্য রাত থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। যা গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একটানা প্রায় ১০টা পর্যন্ত পড়ে। এরপরও দিনভর থেমে থেমেও বৃষ্টি হয়েছে। তবে রাতের বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় শহরের নিচু এলাকা। বেশিরভাগ এলাকার প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবে যায়। বাসা–বাড়ি, দোকানপাটেও পানি ঢুকে পড়ে। পানিবন্দী হয়ে পড়েন লোকজন। সীমাহীন দুর্ভোগ হয় তাদের। সকালে অফিস–আদালতসহ অন্যান্য কর্মস্থলমুখী লোকজনের দুর্ভোগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জলাবদ্ধতায় শহরের প্রধান বা মূল সড়কগুলোতে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে সৃষ্টি হয় যানজট। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে হেঁটেই কর্মস্থলে পৌঁছান। আবার মোটরযান বন্ধ থাকার সুযোগে মর্জিমাফিক ভাড়া দাবি করার অভিযোগ আছে রিকশাওয়ালাদের বিরুদ্ধে।
চার প্রকল্প, তবুও জলাবদ্ধতা কেন? জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র দুইটি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) একটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটিসহ চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে সিডিএ’র দুটি প্রকল্প হচ্ছ– ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনর্খনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্প এবং ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প।
এছাড়া চসিকের রয়েছে এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ‘নগরের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ শীর্ষ প্রকল্প এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প।
এদিকে প্রকল্পের কাজ চলার মধ্যেই গত বছর ৭ বার ডুবে শহর। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত পাঁচবার। চলতি মৌসুমে গত ১ জুলাই, ৩০ জুন, ২৭ ও ৬ মে চার দিন বৃষ্টি হয়েছে নগরে। ওই চার দিনই নগরের অনেক নিম্বাঞ্চলে জলযট সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে বেশি ভোগান্তি হয়েছে ২৭ মে। ওইদিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২৪১ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় নগরে। এতে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে দুর্ভোগ পোহান নগরবাসী। সর্বশেষ গতকালও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ হওয়ায় নগরবাসী জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পগুলোর সুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।
গতকাল সকালে মুরাদপুরে কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী রায়হানের সঙ্গে। আজাদীকে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রতিবছর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাব এমন আশ্বাস শুনি। কিন্তু বাস্তবে তার কার্যকারিতা দেখি না। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে লাভ কী?
গতকালের চিত্র : গতকাল নগরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রবর্তক মোড়, জিইসি, ২ নম্বর গেইট, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, শুলকবহর, বহাদ্দারহাট, কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা, কাতালগঞ্জ বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, কাপাসগোলা, ষোলশহর, বাকলিয়া, হালিশহর সবুজবাগ, ইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, পূর্ব কাঠগড়, মুসলিমাবাদ, কেবি আমান আলী সড়ক, ষোলশহর, আতুরার ডিপোসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরে সমান পানি উঠেছে।
এদিকে হাঁটুর বেশি পানি জমে যায় মোহাম্মদপুর মাজার রোডে। মুরাদপুর সড়কটির পাশের বিভিন্ন দোকানেও পানি ঢুকে যায়। মুরাদপুরে তানভীর নামে এক পথচারী আজাদীকে বলেন, এটা খুব দুঃখজনক একটু বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হয়েছে। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। শুলকবহর এলাকায় আজিজ নামে এক পথচারী আজাদীকে বলেন, কাজ থাকায় বের হতে হয়েছে। জলাবদ্ধতায় সীমাহীন দুর্ভোগ হচ্ছে। চকবাজারের মুহাম্মদ শাহ আলী লেনের আবদুল হামিদ বলেন, ৩ টার পর পানি নেমে যায়।
এ দিকে জলাবদ্ধতা রাস্তায় সংকট ছিল যানবাহনের। শত শত পথচারী গাড়ির অপেক্ষা করছিল সড়কে। এসময় মনগড়া ভাড়া দাবি করছিল চালকরা। কিছু গণপরিবহণেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
বৃষ্টির পরিমাণ : গতকাল সকাল ৬ টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। এছাড়া সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নগরে ১৪৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার এবং দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৪৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, ২৪ ঘণ্টায় ১ থেকে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে হালকা, ১১ থেকে ২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে মাঝারি, ২৩ থেকে ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে মাঝারি ধরনের ভারি, ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে ভারি এবং ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি রেকর্ড হলে তাকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত বলা হয়। ওই হিসেবে গতকাল অতি ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে নগরে।
কী বলছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা : জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান সিডিএ’র মেগা প্রকল্প ববাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে কর্নেল মো. ফেরদাওছ আজাদীকে বলেন, পানি নেমে গেছে। মধ্যম একটা সময় লেগেছে। আগে আমরা দেখতাম পানি নামতে ৪০–৪৫ মিনিট লাগত। আজকে একটু বেশি লেগেছে। মুরাদপুরে দেড় ঘণ্টা মত লেগেছে।
তিনি বলেন, পুরাতন যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়, যেমন ষোলশহরের কিছু অংশ, আগ্রাবাদের মা ও মিশু হাসপাতাল এলাকা, মুরাদপুরের একটা অংশ এবং প্রবর্তক মোড়ে পানি জমেছে এবং তা একটু দেরিতে নেমেছে। জলাবদ্ধতা চলাকালে চারটি রেসপন্স টিম কাজ করেছে। কোথাও প্রতিবন্ধকতা দেখলে তা অপসারণ করে এই টিম।
তিনি বলেন, মির্জা ও হিজরা খালে কাজ করলে মুরাদপুরের অংশটা রিকভার করা যাবে। এর সাথে রিলেটেড যেসব জায়গা সিডিএ ও কাপাসগোলা এসব এলাকাও রিকভার করা যাবে। এবার চাক্তাই খালে এবার খুব ভাল কাজ করেছে। অন্যান্য খালগুলোর পানি প্রবাহও ভালো ছিল।
তিনি বলেন, এবার জলাবদ্ধতার লোকেশন কিন্তু কমে গেছে। কিন্তু পুরাতন যেসব লোকেশন সেগুলো পুরোপুরি রিকভার করতে পারিনি। সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। মির্জা ও হিজরা খালের কাজ হয়ে গেলে সেটা কাভার হয়ে যাবে। তবে গতবছরের চেয়ে এবার অনেক উন্নতি হয়েছে, এটা স্বীকার করতেই হবে।