ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা তুঙ্গে

দিল্লির সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত, আকাশপথও বন্ধ করে দিল ইসলামাবাদ, সিমলা চুক্তি স্থগিত রাখা হতে পারে

| শুক্রবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ at ৪:৫৫ পূর্বাহ্ণ

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। হামলার পর গত বুধবার সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করাসহ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ নেয় ভারত। পালটা জবাব হিসেবে ইসলামাবাদও গতকাল দিল্লির বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ ঘোষণা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে খুঁজে এনে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। অপরদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি পাকিস্তানি নাগরিকরা নিরাপদ না থাকেন, ভারতকেও এর পরিণাম ভোগ করতে হবে। তিনি বলেন, কারো কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়, আমরা সম্পূর্ণভাবে ভারতের যে কোনো অভিযানের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। একই সাথে পাকিস্তান পানি আটকানোর ঘটনাকে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল বলে উল্লেখ করেছে। এ রকম উত্তেজনার মুহূর্তে দুই দেশের মধ্যে সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এক খবরে বলা হয়, যুদ্ধের আশঙ্কায় পাল্টা প্রস্তুতি চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সীমান্ত লাগোয়া ঘাঁটিগুলিতে বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা কর্মকর্তারা। সমাজমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়লেও পাক ফৌজের তরফে অবশ্য এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।

বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, পাকিস্তান গতকাল তার জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে আটটি পদক্ষেপ নেয়। ইসলামাবাদে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলা এ বৈঠক শেষে বিবৃতি প্রকাশ করে শাহবাজ শরিফের সরকার জানায়, তারা ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করে দিচ্ছে। ভারতকে তৃতীয় কোনও দেশে বাণিজ্যের জন্যও তারা নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না। নিজেদের আকাশসীমাও ভারতকে আর ব্যবহার করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। প্রতিটি ভারতীয় বিমান সংস্থার জন্য এই নিয়ম কার্যকর থাকবে বলে জানিয়েছে তারা। এছাড়াও রয়েছে ওয়াগাহ সীমান্ত বন্ধ, সিন্ধুর পানি বন্ধ হলে যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে, ভারতীয়দের সব সার্ক ভিসা বাতিল (শিখ পুণ্যার্থী ছাড়া), ভারতীয়দের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ, ভারতের প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান বাহিনীর উপদেষ্টাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও ৩০ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ এবং ভারতীয় দূতাবাসে সদস্য সংখ্যা ৩০ জনে নামিয়ে আনা।

সিমলা চুক্তি স্থগিত রাখা হতে পারে বলেও জানিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৭২ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমেই জম্মু ও কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা নির্ধারণ হয়েছিল। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, জম্মু ও কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতির সময়ে যে দেশের বাহিনী যেখানে অবস্থান করছে, সেখানেই অবস্থান করবে। কোনও দেশই একতরফা ভাবে নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করবে না।

পাকিস্তান সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কেবল সিমলাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সকল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত রাখার অধিকার প্রয়োগ করবে, যতক্ষণ না ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাস উসকে দেওয়া, সীমান্ত পেরিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানো এবং কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাবসমূহ লঙ্ঘনের মতো স্পষ্ট আচরণ থেকে বিরত হয়।’ ভারত যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সমালোচনা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক এ চুক্তির কোথাও একতরফা চুক্তি স্থগিতের বিধান নেই। পানি পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ, এর ২৪ কোটি লোকের লাইফলাইন। যে কোনো মূল্যে এর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে। সিন্ধু পানি চুক্তির অধীনে পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত পানির প্রবাহ বন্ধ বা অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়ার যে কোনো চেষ্টা এবং নিম্ন অববাহিকার জনগণের অধিকার হরণ যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য বিবেচনা করা হবে এবং জাতীয় শক্তির সর্বস্তরের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দিয়ে এর মোকাবেলা করা হবে।’

ভারতীয় বিমানসংস্থাগুলির জন্য পাকিস্তান তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়ায় এ বার থেকে ভারতের মালিকানাধীন বা ভারতে নিয়ন্ত্রিত কোনও বিমান পাকিস্তানের উপর দিয়ে যেতে পারবে না। ফলে উত্তর ভারত থেকে পশ্চিমের দিকে বিমানগুলিকে যেতে হবে আরব সাগরের উপর দিয়ে। এতে বাড়তি জ্বালানি খরচ হবে বিমানগুলির। এর ফলে যাত্রার খরচও আগের চেয়ে বেড়ে যাবে। মনে করা হচ্ছে, পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের ফলে ভারতে বিমান ভাড়া ৮ থেকে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে চলেছে। এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আগামী দিনে ভাড়া আরও বাড়তে পারে। বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হলে বিমানগুলিতে আরও বেশি জ্বালানি রাখতে হবে। তার ফলে সার্বিক ভাবে বিমানের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয় যাত্রীসংখ্যা, নয়তো জিনিসপত্রের ওজন কমাতে হবে। যাত্রীসংখ্যা কমিয়ে দিতে হলে বিমানসংস্থাগুলির আয় কমবে। ফলে সেগুলি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। এর আগেও ২০১৯ সালে বালাকোটে ভারতের বিমান হামলার পর পাকিস্তান কয়েক মাসের জন্য আকাশসীমা বন্ধ রেখেছিল।

এদিকে কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় সংসদ ভবনে সর্বদলীয় বৈঠক করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। গতকাল সন্ধ্যায় শুরু হওয়া বৈঠকে বিজেপি, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আমআদমি পার্টি, আরজেডি, শিবসেনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীবলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেন্দ্র যাই পদক্ষেপ করুক, তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বিরোধীদের। রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে গোয়েন্দাব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নেয় কেন্দ্র। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘যদি কিছু ভুল নাই হয়ে থাকে, তা হলে আমরা এখানে বসে আছি কেন? কোথাও না কোথাও ব্যর্থতা রয়েছে, সেটিই খুঁজে বার করতে হবে।’

এর আগে জঙ্গিদের কল্পনাতীত শাস্তি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী। বলেন, ‘আজ আমি গোটা বিশ্বকে বলতে চাই, ভারত অবশ্যই প্রত্যেক সন্ত্রাসবাদীকে খুঁজে বার করবে। তাদের চিহ্নিত করবে এবং শাস্তি দেবে। শাস্তি দেবে তাদের মদতদাতাদেরও।’ শুরু থেকেই হিন্দিতে ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই মন্তব্য করার সময় ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়া শুরু করেন তিনি। মনে করা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ভারতের অনমনীয় অবস্থান গোটা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট করতেই ইংরেজিতে জঙ্গিদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন মোদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিযোগী বিশ্বে টিকতে হলে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতি দরিদ্র’ হয়ে পড়বে : বিশ্ব ব্যাংক