ভারতের উপর দিয়ে যোগাযোগে জোর বাংলাদেশের

হাসিনা-মোদী বৈঠকে ৫ সমঝোতা স্মারক ।। উঠেছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও তিস্তা চুক্তির কথা

| রবিবার , ২৮ মার্চ, ২০২১ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি সড়কপথে থাইল্যান্ডের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তৈরিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সহযোগিতা চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার দুই সরকার প্রধানের নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।
তিনি বলেন, বিবিআইএন মোটর ভেহিকেলস এগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে ’ত্রিদেশীয় এনাবলিং এমওইউ’ দ্রুত স্বাক্ষরের বিষয়ে দুই নেতা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আরো বৃহত্তর পরিসরে অভিগম্যতা চায় বাংলাদেশ। এজন্য বাংলাদেশ নতুন কিছু রুট অনুমোদনের জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্ব, সময় ও ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে ‘ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক’ প্রকল্পে যুক্ত হতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও ভারতকে জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে সমপ্রতি উদ্বোধন হওয়া ’চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল রুট’ ব্যবহার করে ভুটানের সঙ্গে রেল কানেক্টিভিটি তৈরিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও ভারতকে জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মোমেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য সমপ্রসারণের লক্ষ্যে বলিষ্ঠ আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর দুই সরকার প্রধানই জোর দিয়েছেন।
হাসিনা-মোদী বৈঠকে ৫ সমঝোতা স্মারক : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, তথ্য প্রযুক্তি ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। গতকাল শনিবার ঢাকায় নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ভারতের আরও সক্রিয় ভূমিকা চায় বাংলাদেশ। এছাড়া দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা উঠেছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে যোগ দিতে শুক্রবার সকালে দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল বিকাল ৫টার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে শেখ হাসিনা তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। দুই সরকার প্রধান প্রথমে কিছু সময় একান্তে বৈঠক করেন। পরে তাদের নেতৃত্বে শুরু হয় দুই দেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক।
তাদের উপস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, তথ্য প্রযুক্তি ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই করে দুই দেশ। এ সময় শিলাইদহের কুঠিবাড়ির সংস্কার কাজের সমপ্রসারণ প্রকল্প এবং তিনটি সীমান্ত হাটের উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে হোটেল সোনারগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে দুই সরকার প্রধানের আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সফরটি যদিও কিছুটা উদযাপনের, তারপরও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বহুমাত্রিক ও বিস্তৃত পরিসরে দুই পক্ষের মধ্যে অত্যন্ত অর্থবহ ও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা হয়েছে। ফলে, বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও বেগবান ও জোরদার হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
মোমেন বলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আনা এবং বাণিজ্য অবারিত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাণিজ্য সহজীকরণের পদক্ষেপ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষ শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা অপসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য রপ্তানির ওপর ২০১৭ সাল থেকে ভারত কর্তৃক আরোপিত ’অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি’ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা সমপ্রসারণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার ওপরও দুই প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েছেন বলে জানান মোমেন।
তিনি বলেন, পণ্যের মান নির্ধারণের বিষয়ে বিএসটিআই এবং ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের (বিআইএস) মধ্যে নিবিড় সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে আরো বেশি ভারতীয় বিনিয়োগের আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন মোমেন।
দুই প্রধানমন্ত্রী ‘নিউ জলপাইগুঁড়ি-ঢাকা রুটে’ যাত্রীবাহী ট্রেন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মহামারী পরিস্থিতির উন্নয়ন সাপেক্ষে যত দ্রুত সম্ভব বিমান, বাস ও ট্রেনযোগে এবং স্থলবন্দরগুলোর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যাবে দুই দেশ।
তিনি জানান, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশ যাতে নিয়মিতভাবে সরবরাহ পায়, সে বিষয়ে ভারতকে অনুরোধ করা হয়েছে। ভারত সরকার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ স্থাপনের একটি ঘোষণা বৈঠকে দিয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জ্বালানি ও নিরাপত্তা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা, বিশেষ করে নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। মৌসুমি পরিস্থিতি ও ব্যয় সাশ্রয়ের নিরীখে নেপাল ও ভুটানে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ ব্যবহারে আগ্রহী বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে সদ্য সম্পাদিত যৌথ বিবৃতিতেও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আজ আমরা জ্বালানি উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছি। আমরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জ্বালানি ঘাটতির এলাকায় বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে চাই।
মোমেন জানান, ভারতের ঋণচুক্তির (এলওসি) আওতাধীন প্রকল্পগুলোকে আরও বেগবান করার ব্যাপারেও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটিকে তারা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ভারত।
তিনি জানান, সীমান্তে একজন বাংলাদেশিও যেন কোনো কারণে বিএসএফের হাতে নিহত না হন, সেটি নিশ্চিত করার জোরালো দাবি উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সীমান্তে শান্তি, সমপ্রীতি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার লক্ষ্যে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (সিবিএমপি) আওতায় বিজিবি ও বিএসএফকে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
ঝুঁকিপূর্ণ চলাফেরা পরিহার করতে সীমান্তবর্তী এলাকার নাগরিকদেরকে সচেতন করে তোলার কার্যক্রম পরিচালনারও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে মন্তব্য করেন মোমেন।
৬ ডিসেম্বর মৈত্রী দিবস : স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির দিন ৬ ডিসেম্বরকে ‘মৈত্রী দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দিবসটি যৌথভাবে উদযাপনের ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ পরিবর্তনের নজির, ভারত সহযোগী : মোদী
পরবর্তী নিবন্ধথমথমে হাটহাজারী, সড়কে দেয়াল