বিশ্ব ক্রিকেটে অনেক দলই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর খেতাব লাভ করেছে। তবে নানা কারণে সামপ্রতিক সময়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেকোন লড়াইয়ের সাথেও চির প্রতিদ্বন্দ্বী ট্যাগটা লেগে গেছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের খেলা হলে সংগত কারণেই উত্তেজনাটা একটু বাড়তি থাকে। গতকাল অনূর্ধ্ব–১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালেও সে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল পরতে পরতে। জয়ের সুবাস পেয়ে গ্যালারিতে উল্লাস চলছিল অনেকক্ষণ ধরেই। ম্যাচ শেষ হতেই সেই উচ্ছ্বাসে যেন নতুন প্রাণের দোলা লাগল টাইগার যুবাদের মাঝে।
মাঠের ভেতরে তখন নানা আবেগের স্রোত। কেউ ডানা মেলে উড়ছেন, কেউ দিগ্বিদিক ছুটছেন। দেশের পতাকার দুই প্রান্তে ধরে ছুটে গেলেন দুজন। মারুফ মৃধাকে কাঁধে তুলে নিলেন কেউ একজন। শেষ উইকেটটি নিয়ে অধিনায়ক আজিজুল হাকিম তামিম হাঁটু গেঁড়ে বসে হাত দিয়ে ঢেকে রইলেন মুখ। যেন মুহূর্তটি অনুভব করতে চাইলেন প্রাণভরে। সব মিলিয়ে দুবাইয়ের গ্যালারি থেকে মাঠে একাকার লাল–সবুজের শিরোপা উৎসব।
অবশ্য এমনতো হওয়ারই কথা। ভারতের মত প্রতিপক্ষকে একরকম উড়িয়ে দিয়ে এশিয়া কাপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ দল। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ দল ৫৯ রানের বড় ব্যবধানে ভারত অনূর্ধ্ব–১৯ দলকে পরাজিত করে শিরোপা ধরে রাখল। আগের আসরে স্বাগতিক আরব আমিরাতকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের শিরোপা জিতেছিল টাইগার যুবারা।
বাংলাদেশ দল ব্যাটিংয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও দুর্দান্ত বোলিং আর ফিল্ডিংয়ের কারণে শিরোপা জিতেছে। বলা যায়–একটি দল হিসেবে কীভাবে খেলতে হয় তারই যেন প্রদর্শনী করল টাইগার যুবারা। টুর্নামেন্টের প্রথম ৯ আসরে একবারও শিরোপা জিততে না পারা বাংলাদেশ গত আসরে খরা ঘোচানোর পর এবার জিতে নিল টানা দ্বিতীয় শিরোপা। এবারের আসরে ফাইনালের আগে গ্রুপ পর্বেও এই ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ফলে ভারতের উপর নিজেদের আধিপত্যও বজায় রাখল বাংলাদেশের যুবারা।
ফাইনাল পর্যন্ত দলকে ব্যাটিংয়ে টেনেছেন অধিনায়ক আজিজুল হাকিম তামিম। কিন্তু ফাইনালে তিনি বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। তবে কয়েকজনের সম্মিলিত অবদানে কিছুটা লড়ার মতো রান পায় দল। এরপর বাকি দায়িত্ব নিয়ে নেয় দুর্দান্ত পেস আক্রমণ। টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ বোলিং করা ইকবাল হোসেন ইমন জ্বলে ওঠেন ফাইনালেও। আল ফাহাদ, মারুফ মৃধা, রিজান হাসান যথারীতি ছিলেন কার্যকর। ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা পুষিয়ে বোলিংয়ে তিন উইকেট নেন আজিজুল। সঙ্গে তার ঠাণ্ডা মাথায় কুশলী নেতৃত্ব তো ছিলই। সেমি–ফাইনালে চার উইকেট নিয়ে ম্যাচ–সেরা হওয়া ইমন ফাইনালেও সেরার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ৩ উইকেট। আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিও তিনি। নিয়েছেন ৫ ম্যাচে ১৩টি উইকেট। সে সুবাধে ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্টের পুরষ্কারও জিতেছেন এই পেসার।
ফাইনালে টসে হেরে ব্যাট করতে নেমেছিল বাংলাদেশ। ১৬ বল খেলে ১ রান করা কালাম সিদ্দিকী ফিরেন ১৭ রানের মাথায়। অধিনায়ক আজিজুল ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলেই জোরাল আবেদন থেকে বেঁচে যান। আরেক প্রান্তে জাওয়াদকে ২০ রানে বিদায় করেন চেতান শার্মা। ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে রানের গতি কমে আসে অনেকটা। সেটিরই বলি হন আজিজুল। স্লগ সুইপে ছক্কা মারার চেষ্টায় বাংলাদেশ অধিনায়ক আউট হন ১৬ রান করে। বিপদে থাকা দলকে কিছুটা উদ্ধার করেন মোহাম্মাদ শিহাব জেমস ও রিজান হাসান। চতুর্থ উইকটে ৬২ রানের জুটি গড়েন দুজন। তবে ইনিংস বড় করতে পারেননি কেউই। ৬৭ বলে ৪০ রানে আউট হন জেমস। দারুণ খেলতে থাকা রিজান বিদায় নেন ৬৫ বলে ৪৭ রান করে। এরপর আর কোনো জুটি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এক প্রান্ত আগলে ৩৯ রান করে দলকে দুইশর কাছে নিয়ে যান কিপার–ব্যাটসম্যান ফরিদ হাসান। শেষ পর্যন্ত ১৯৮ রানে থামে বাংলাদেশ।
১৯৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা ভারতের বড় ভরসা ছিল তাদের দুই ওপেনার। কিন্তু বিপজ্জনক দুই ব্যাটসম্যানকেই দ্রুত ফেরায় বাংলাদেশ। ১৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান আয়ুশ মাত্রে ১ রানেই বোল্ড হন ফাহাদের বলে। আইপিএলে কোটি রুপিতে দল পেয়ে আলোড়ন তোলা ১৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান বৈভাব সুরিয়াভানশি দুটি চার মারেন মারুফ মৃধার তিন বলের মধ্যে। তবে পরের বলেই স্লোয়ারে তাকে ফিরিয়ে দেন মারুফ। ২৪ রানে দুই ওপেনার নেই। তৃতীয় উইকেটে ২০ রান যোগ করেন আন্দ্রে সিদ্ধার্থ এবং কেপি কার্তিকেয়া। ২০ রান করা সিদ্ধার্থকে বোল্ড করেন রিজান। এরপর কার্তিকেয়াও ফিরেছেন ২০ রানের কোটা স্পর্শ করে। ২১ রান করা কার্তিকেয়া ফিরেন ইমনের প্রথম শিকার হয়ে। তখনো লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন অধিনায়ক মোহাম্মাদ আমান। শেষ পর্যন্ত তাকেও দিতে হলো রণে ভঙ্গ। ৬৫ বলে ২১ রান করা আমানকে বোল্ড করে ভারতের সম্ভাবনা একরকম শেষ করে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আজিজুল হাকিম। এরপর কেবল শেষের অপেক্ষা। লোয়ার অর্ডারে হার্দিক রাজ ও চেতান শার্মা একটু অপেক্ষা বাড়ান বাংলাদেশের অপেক্ষা। তারপরও ভারতের ইনিংস শেষ কেবল ৩৫.২ ওভারে ১৩৯ রানে। বাংলাদেশের পক্ষে ৪টি উইকেট নিয়েছেন ইকবাল হোসেন ইমন। ৩টি উইকেট নিয়েছেন অধিনায়ক আজিজুল হাকিম তামিম।
ম্যাচ শেষের পর বাংলাদেশের উদযাপন চলে লম্বা সময় ধরে। গ্যালারিতে দর্শক যত ছিলেন, বেশির ভাগই ছিলেন বাংলাদেশের সমর্থক। তাদের কাছে গিয়ে ভালোবাসা–কৃতজ্ঞতা জানান ক্রিকেটাররা। ২০২০ যুব বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ দলের কোচ নাভিদ নাওয়াজের কোচিংয়েই এই দলটি তৈরি হচ্ছে ২০২৬ যুব বিশ্বকাপের জন্য। আসরটি হবে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ায়।