ভাড়ায় খাটছে ভিক্ষুকরা

মাসিক বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ।। ভিক্ষুক ব্যবসায়ীদের দাপটে অসহায় তারা ।। রমজান মাসে ভিক্ষুক ব্যবসায়ীর আয় ২৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা

ঋত্বিক নয়ন | শুক্রবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের মানুষ রোজা এবং ঈদে উদার হস্তে দানখয়রাত করেন। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আয়োজন করে দেন যাকাতফিতরা। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে তাই নগরীতে ভাড়া করা মৌসুমী ভিক্ষুকের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীপুরুষ ও শিশুরা দলবেঁধে পরিবার নিয়ে নগরীর মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিচ্ছে। পথচারীদের দেখলে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। একজনকে ভিক্ষা দিতেই অন্যজন পোশাক ধরে টানাটানি শুরু করে। রীতিমত ভিক্ষা কেড়ে নেয়ার মতো অবস্থা। দলবেঁধে দিনেরাতে ভিক্ষার পর বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন কিংবা ফুটপাতেই ঘুমিয়ে পড়ছে তারা। রমজান শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকার হতদরিদ্ররা ভিক্ষা ও যাকাতের টাকা অথবা কাপড়ের জন্য নগরীতে আসছে। তবে এরা নিজ উদ্যোগে নয়, এক শ্রেণীর দালালের মাধ্যমে মাসিক চুক্তিতে ভাড়ায় গ্রাম থেকে নগরীতে আসছে। রমজান ও ঈদ শেষে তারা আবার নিজ এলাকায় চলে যাবে। এরকম একজন মৌসুমী ভিক্ষুককে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেয়া হবে বলে আনা হচ্ছে। বিভিন্ন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। কিছু ভিক্ষুক রয়েছে যারা অভাবের তাড়নায় নিজ উদ্যোগে নগরীতে এসেছে। তবে ভিক্ষুক ব্যবসায়ীদের দাপটের কারণে তারা বাধ্য হয়ে ভাড়া খাটছে। নগরীর কাজির দেউড়ি, স্টেডিয়াম এলাকা, ইস্পাহানি মোড়, জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ, জিইসি মোড়, দামপাড়া, নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, দেওয়ানহাট মোড়, নয়াবাজার বিশ্বরোড মোড়, আগ্রাবাদ মোড়সহ বড় বড় মসজিদ ও মাজারের আশপাশে এমনকি আবাসিক এলাকাগুলোতেও বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি চোখে পড়ছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক পয়েন্টগুলোতে এদের ব্যাপক উপস্থিতি ও ভিক্ষাবৃত্তির কারণে সড়কে রীতিমত বিশৃঙ্খলারও সৃষ্টি হচ্ছে। মাসে ১৫ হাজার টাকার চুক্তিতে ভিক্ষা করার জন্য নগরীতে এসেছেন রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকার বিধবা মর্জিনা বেগম। তাকে নগরীতে এনেছেন ভিক্ষুক ব্যবসায়ী মনির। চুক্তি হয়েছে পুরো রমজানে মর্জিনার যা আয় হবে তার সবটাই তুলে দিতে হবে মনিরের হাতে। আর মনির ১৫ হাজার টাকা বেতন দিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। গতকাল বৃহস্পতিবার মিসকিন শাহ মাজার এলাকায় মর্জিনা বেগম এসব তথ্য জানিয়েছেন। সূত্র মতে, ভিক্ষুক ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর রমজান ও ঈদুল ফিতরের আগে কয়েক হাজার হতদরিদ্রকে নগরীতে আনে। ঈদ শেষে তাদের আবার গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। রমজান মাসে ভাড়াটে ভিক্ষুকদের কল্যাণে একেক জন ভিক্ষুক ব্যবসায়ীর সর্বনিম্ন আয় হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা! এলাকা ভেদে তাদের প্রত্যেকের অধীনে ৪০ থেকে ৫০ জন ভাড়াটে ভিক্ষুক কাজ করে। রমজানে প্রতিদিন এমন এক ভিক্ষুক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা আয় করে। সেই হিসেবে তার মাসিক আয় ৬০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। আর সে অনুযায়ী একজন ভিক্ষুক ব্যবসায়ীর তখন আয় হয় ২৪ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত।

ভিক্ষুক মর্জিনা আরো জানান, স্বামী নুরুল হকের মৃত্যুর পর ৩টি মেয়ে নিয়ে ঠিক মতো এক বেলাও খাবার জুটতো না তাদের। দুবছর আগে ভিক্ষুক ব্যবসায়ী মনিরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মনির গত বছর রমজানে ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় তাকে চট্টগ্রাম এনেছিল। তখন তিনি মনিরকে ৬০ হাজার টাকা আয় করে দিয়েছিলেন। সাইজুদ্দিন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই বৃদ্ধ জানান, ছেলেমেয়েরা তাকে ভাতকাপড় দেয় না। ভিক্ষুক ব্যবসায়ী আজমত আলী তাকে ১৩ হাজার টাকা বেতনে চট্টগ্রাম এনেছে। সাইজুদ্দিনের শরীরের চামড়া শুকিয়ে গেছে। ঠিকমতো চোখে দেখতে পারেন না। তিনি জানান, ভিক্ষা করা তার পেশা নয়। এক মাসের জন্য ভাড়ায় ভিক্ষা করার জন্য এসেছেন। বাকি ১১ মাস গ্রামে পড়ে থাকেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাইফুদ্দিন বলেন, সব থেকে অসম্মানের কাজ করি। মানুষের গালি শুনি, কেউ খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়। কেউ বঁাঁকা চোখে তাকায়। তারপরও দুঃখ পাই না। কারণ আজমত আলী দুবেলা খেতে দেয়। ভালো কিছু না দিলেও দুটি রুটি হলেও দেয়। আর গ্রামে থাকলে কোনো কাজ করতে পারি না। সন্তানরা খেতে দেয় না। বৃদ্ধ বয়সে না খেয়ে থাকার কষ্ট কতো আমি জানি।

মর্জিনা, সাইজুদ্দিনের মতো আলেয়া, আব্দুল খালেক, রাজ্জাকসহ আরো অনেককেই ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এরা কেউ জানেন না তাদের মালিকরা কোথায় থাকে, কি করে। এমনকি মালিকরা তাদের কাছে যে নাম বলেছে সেটাও সঠিক কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। সকালে রিকশায় করে একেক জনকে একেক এলাকায় রেখে আসা হয়। আবার রাতে ওই রিকশা তাদের নিয়ে আসে। কোনো কোনো দলকে রাতের বেলা বাস টার্মিনাল বা রেল স্টেশনে রেখে আসা হয়, আবার গভীর রাতে নিয়ে যায়। কার ডিউটি কোনো এলাকায় পড়বে সেটা মালিকরা ঠিক করে থাকে। একজনকে একই স্থানে খুব বেশি রাখা হয় না বলে তারা জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসরায়েলের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের ব্যবস্থা চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপবাসীর ঈদযাত্রায় ভরসা কেবল এমভি আইভি