হীরালাল সেন তাঁর জীবদ্দশায় চরম ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন। নিজের জীবনের, পরিবারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে অবলীলায় তুচ্ছ করে এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চর্চার পথিকৃতের যে কাজটি তিনি করেছিলেন, তার স্বীকৃতি তিনি হারিয়েছিলেন ভিনদেশী ব্যবসায়ীদের চক্রান্তে। যে চক্রান্তে সামিল হয়েছিলেন তাঁর সহোদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা, তাঁর নিজের সমাজ, তাঁর সহকর্মী, তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতিজন।
মৃত্যৃর পরেও দুর্ভাগ্য তাঁর পিছু ছাড়েনি। আজো তিনি তাঁর প্রকৃত স্বীকৃতি পাননি। না তাঁর জন্মভূমি পিতৃভূমি বাংলাদেশে, না তাঁর কর্মভূমি ভারতে। এর একটাই কারণ, তিনি বাঙালি, তাও আবার পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি। ফলে দিল্লি, কলকাতা ও ঢাকা সর্বক্ষেত্রেই তিনি ব্রাত্য।
প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র আলিবাবা, প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র জবাকুসুম তেল এবং অনেকগুলি সংবাদচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা তিনি। লুমিয়ের ব্রাদার্স থেকে তিনিই চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিলেন, বিদেশি প্রদর্শক স্টিফেনসনের প্রদর্শিত চলচ্চিত্র দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে। ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল শৈশব থেকে। ছবি তুলতেনও চমৎকার। স্থিরচিত্র থেকে চলচ্চিত্রে তাঁর চিত্রভাবনা এভাবেই বিবর্তিত হয়।
কিন্তু তার জীবদ্দশায় এ উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের পথিকৃতের ভূমিকা লুট হয়ে যায় মহারাষ্ট্রের দাদাসাহেব ফালকে ও ইরানি ব্যবসায়ী জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডানের কাছে।
ভগ্নহৃদয় ও ভগ্ন শরীরে গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা অল্প বয়সেই হীরালাল মারা যান। আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাঁর
নির্মিত সব ছবি, যেগুলো প্রতারণা করে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন ছোট ভাই মতিলাল।
হীরালাল সেনের জীবনী আজ আর দুষ্প্রাপ্য নয়। বাংলাদেশে ১৯৮০’র দশক থেকে তাঁকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার কাজুড়ি গ্রামে হীরালালের জন্ম। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে হীরালাল সেনকে নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন যাঁদের মধ্যে অনুপম হায়াত ও ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম অন্যতম। কলকাতাতেও দীর্ঘদিন ধরে হীরালাল সেনকে নিয়ে চর্চা করা হচ্ছে। যেটা লক্ষণীয় এবং উৎসাহব্যঞ্জকও বটে তা হলো, নবীন প্রজন্মের মধ্যে তাঁকে নিয়ে উৎসাহ।
তবে দীর্ঘদিন পর এই প্রথম হীরালাল সেনকে নিয়ে কোনো কাহিনীচিত্র নির্মিত হলো। ২০২১ এর ৫ মার্চ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে কলকাতায়। ‘হীরালাল’ নামের এই গুরুত্বপূর্ণ বায়োপিকটি নির্মাণ করেছেন অরুণ রায়। বায়োপিকটির ভাবনা এবং চিত্রনাট্য তাঁর। ছবিটি দেখে বোঝা যায় যথেষ্ট গবেষণা ও শ্রমলব্ধ কাজ এটি। যথেষ্ট পরিমিত বোধ বজায় রেখে দুই ঘন্টা ১৭ মিনিটে তিনি হীরালালের পুরো জীবনকে ধরেছেন যাতে সহায়তা করেছেন সম্পাদক সুজয় দত্ত রায়।
হীরালালের জীবনচিত্রের পাশাপাশি আনুষঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে সেই সময়ের মঞ্চ। মঞ্চের কিংবদন্তী কুশীলব, নটনটী প্রাসঙ্গিক চরিত্র হিসেবে চিত্রনাট্যে স্থান করে নিয়েছেন। চলচ্চিত্রের আগমনের পর মঞ্চের বিবর্তন, চলচ্চিত্র ও মঞ্চের পারস্পরিক সম্পর্ক, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের নানা রাজনীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিবিধ টানাপোড়েন যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক।
আমাদের এতদাঞ্চলে শুদ্ধ বায়োপিক বা জীবনীচিত্রের প্রচলন নিতান্তই কম। যা কিছু নির্মিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে মাইকেল, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, সুভাষচন্দ্র কিংবা বাংলাদেশে ভাউয়াল, সন্যাসী, ঈশা খাঁন, তানসেন, লালন ফকির, মজনুশাহ, সবেতেই মনগড়া এবং কষ্ঠকল্পিত ঘটনাবলির মিশেল দেয়া হয়েছে। ফলে এসবের কোনোটাই বায়োপিক হয়ে ওঠেনি।
সেদিক থেকে অরুণ রায়ের ‘হীরালাল’ যথেষ্ট পরিণত। ইতিহাসের যথার্থতা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। এটা বিশ্বের সকল বায়োপিকেই রয়েছে। তবুও অরুণ রায়ের এ ছবি যে অনেক পরিশ্রম লব্ধ এটা বোঝা যায়। যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে পরিচালক এই পথিকৃৎকে তাঁরই (হীরালাল) প্রিয় মাধ্যমটিতে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। অন্তত এভাবে হলেও প্রয়াণের (২৯ অক্টোবর ১৯১৭) ১০৪ বছর তিনি বেঁচে উঠলেন। এ চর্চা অব্যাহত থাকলে হয়তো একদিন তিনি তাঁর যোগ্য স্বীকৃতি পেতেও পারেন। তাঁর জন্মভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ অনেক কিছুই করতে পারে তাঁর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চেয়ার, ঢাকা (মানিকগঞ্জ তখন ছিল ঢাকা জেলার মহকুমা) শহরের একটি সড়কের নামকরণ, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি এবং তাঁর নামে আজীবন সম্মাননা পদক প্রবর্তন। কোনেটাই অসাধ্য কিংবা ব্যয়বহুল নয়। এতে বরং বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে।
বায়োপিক ‘হীরালাল’কে গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে শিল্পী কলাকুশলীদের আন্তরিক অংশগ্রহণ যারা প্রায় সকলেই নবীন। অভিনয় শিল্পী নির্বাচন যথাযথ যার দায়িত্বে ছিলেন সৌনাভ বসু, যিনি ছবির সংলাপও লিখেছেন। অভিনয়ে কিঞ্জল নন্দা (হীরালাল), অনুষ্কা চক্রবর্তী (হেমাঙ্গিনী), পার্থ সিনহা (মতিলাল), খরাজ মুখোপাধ্যায় (গিরিশ ঘোষ), শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (ম্যাডান), অর্ণ মুখোপাধ্যায় (অমরদত্ত) এবং তনিষ্ঠা বিশ্বাস (কুসুম কুমারী) অত্যন্ত সাবলীল। এদের অভিনয়কে বিশ্বস্ত করে তুলেছে শেখ আজাদ আহমেদের যুৎসই রূপসজ্জা। ময়ুখ-সৈনাকের করা সংগীতও ভালো। তেমনই যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন চিত্র গ্রহণ করেছেন গোপী ভগৎ। সম্পাদনায় পরিমিতির পাশাপাশি সিকোসেন্স ট্রানজিশনও বেশ ভালো। বায়োপিকের গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব ছিলেন রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায় এবং প্রযোজনার বৃহৎ ও মহৎ দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্দ্রজিৎ রায়।
হীরালাল সেন ছিলেন একজন সমাজ সচেতন শিল্পী। অনেক সময় নির্ধারিত স্যুটিং বাদ রেখে ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্রায়নে ছুটে যেতেন তিনি বিরাট লোকসানের ঝুঁকিকে অবজ্ঞা করে। বলতেন, ‘বায়োস্কোপ শুধু বিনোদন নয়, এ-তো ইতিহাস।’ এজন্য অবশ্য তাঁকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তবুও তিনি পিছপা হননি। বলতেন, ‘হীরালাল পয়সার জন্য ছবি তোলেন না, ছবি তোলে নিজের জন্য।’ মাধ্যমটিকে ভালোবাসতেন। তাই নিজের দিকে, পরিবারের দিকে না তাকিয়ে চলচ্চিত্রের সেবায় নিয়োজিত থাকতে চেয়েছেন। তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করে তাই আমরাও বলতে পারি, ‘হীরালাল সেন একজনই।’