বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা

ড. নারায়ন বৈদ্য | সোমবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

ছাত্রজীবনে একটি কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকতাম, মানুষের সংক্ষিপ্ত জীবনকালটা কোথায় কাটালে ভাল হয়- তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হাস্যরসিকতার সাথে বলতাম, শিশুকাল কাটানো উচিত জাপানে। কারণ জাপানে শিশুদের নিরাপত্তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো। আর যৌবনকাল কাটানো উচিত ইউরোপে। কারণ যৌবনকালে নিজকে বিকশিত করার জন্য এবং মেধার বিকাশ ঘটানোর জন্য ইউরোপে অবাধ সুযোগ রয়েছে। আর অবসর বা বৃদ্ধকাল কাটানো উচিত বাংলাদেশে। কারণ এখানে সন্তানেরা পিতা-মাতার প্রতি অতীব যত্নবান। অতএব বৃদ্ধকালটা অতি যত্নে সন্তানদের নিকট থেকে কাটিয়ে দেয়া যাবে। পরবর্তী কর্মময় জীবনেও এ ধারণার বশবর্তী হয়ে আত্ম-প্রসাদ লাভ করতাম।
২০১৯ সালের মধ্যভাগে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। আমার লেখাটির জন্য প্রায় পঞ্চাশজন পাঠক আমাকে মোবাইলে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। এটি প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেক পর এক আশ্চর্য ঘটনার মুখোমুখি হলাম আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করে বিকাল পাঁচটার দিকে বাসায় এসেছি। একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা ৭.০০ টার দিকে কিছু বাজার করবো বলে বের হলাম। একান্ত মনে বাজারে যাওয়ার পথে বেশ মোটাসোটা একজন লোক আমার সামনে এসে, মনে হলো- আমার পায়ে ধরবে। আমি একটু বিব্রত হয়ে ভদ্রলোকের দুই বাহু ধরে দাঁড় করালাম। ভালো করে লক্ষ্য করলাম এ ভদ্রলোকের দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আলো আঁধারিতে খেয়াল করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমার পা ছুঁইতে চাইলেন, আবার কাঁদতেছেন, কিন্তু কেন? এ সময়ে আমার নিজের কাছে বেশ অপরাধী মনে হলো। একটু পরে খেয়াল করে দেখলাম, সেই ভদ্রলোক অন্য কেউ নয়। সেই আমার মধ্য বয়সের একজন ছাত্র। সময়ের পরিবর্তনে তার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেহের বিশাল পরিবর্তনে তাকে আমি চিনতে পারিনি। সে নিজ থেকে পরিচয় দিতে লাগল। তখনো তার দুই চোখ গড়িয়ে জল পড়তেছে। জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কাঁদছো কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি? আমার সামনে থেকে একটু পিছনে গিয়ে দুই হাত জোড় করে বলতে লাগলো- স্যার, আমি আপনার নিকট দুই বছর পড়েছি। সময়ের পরিবর্তনে সংসারও করেছি। চাকুরী করে দুই সন্তান নিয়ে সুখে থাকার ইচ্ছায় পিতা-মাতাকে কখনো এত প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি। তাই অবহেলাই করে এসেছিলাম। কিছুদিন আগে দৈনিক পত্রিকায় বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আপনার একটি লেখা আমি বার বার পড়েছি। লেখা পড়তে পড়তে আমার ছোটকাল থেকে বড় হওয়া, লেখাপড়া শেখা, বাবার নিকট থেকে প্রতিমাসে পড়ার জন্য টাকা আনতে যাওয়া, বাড়িতে গেলে মা ভাল ভাল খাবার খাওয়ানোর পর আসার সময় রাস্তার মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যাওয়া- সব কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আমি আজ আমার সন্তানকে যেভাবে আগলে রেখেছি, ঠিক এইভাবে আমার মা-বাবা আমাদের ভাই-বোনদেরকে আগলে রেখে ছিল। পরদিন অফিসে গিয়ে দুই দিনের ছুটি নিলাম। বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের পা ছুঁইয়ে ক্ষমা চেয়েছি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি- মা-বাবাকে শহরে আমার সাথে রাখবো। এখন মা-বাবা আমার সাথে আছে। আপনার লেখা যদি না পড়তাম তবে আমার ভুল ভাঙতো না। আপনাকে হঠাৎ দেখা পেয়ে আমার ছাত্র-জীবনের সব কথা এবং বাবা-মায়ের কষ্টের কথা মনে পড়ে গেল। ছাত্রটিকে আমার সহজাত প্রবৃদ্ধির নিরিখে কিছু উপদেশ দিয়ে অবশেষে বিদায় হলাম।
এর মধ্যে রাত ৮.০০টা বেজে গেছে। তাকে বিদায় দিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করলাম- আমি একজন শিক্ষক। দীর্ঘ ৩৬ বছর শিক্ষকতা করছি। আর যাই হোক, বর্তমান প্রজন্মের কিছু মানুষকে হলেও সুন্দরের পথে আনতে পেরেছি। তাদের অন্তরের প্রদীপ শিখাকে জ্বালাতে পেরেছি। তাছাড়া একজন শিক্ষক হিসেবে এর বাইরে তো আমার আর কিছুই করার নেই।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের বিবেককে কি জাগ্রত করতে পেরেছি? না, পারিনি। এ প্রজন্মের অধিকাংশ ব্যক্তির মানবতাকে জাগ্রত করতে হলে এ দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এ বিষয়ে একটি সুখপাঠ্য অন্তুর্ভুক্ত করতে হবে। এমন কি তা ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থায়ও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যথায় সন্তানদের বিবেকবোধ পরিপূর্ণভাবে জাগ্রত হবে না। এ দেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এটাই দেখা যাচ্ছে।
এ যে, মাত্র এক বৎসর আগে চট্টগ্রামে এক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, অবসর পরবর্তী পাওনা টাকা এবং চাকুরি জীবনে জমানো টাকা দিয়ে শহরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। তাঁর তিন পুত্র নিয়ে তিনি অবসর পরবর্তী জীবন ভালোভাবে কাটাচ্ছিলেন। তিন পুত্র চাকুরি ও ব্যবসা করতেন। সন্তানদের উন্নতির জন্য পিতা তার জমানো টাকাগুলো তিন পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বৎসর পার হতে না হতেই তিন পুত্র দাবী করে বসলেন যে, ফ্ল্যাট পুত্রদেরকে ছেড়ে দিয়ে পিতা-মাতা যেন অন্যত্র তথা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যায়। বৃদ্ধ পিতা-মাতা পড়ে গেল মহাবিপদে। অবশেষে পিতা জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে আইনের সাহায্য নিয়েছিলেন। আইন শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে রক্ষা করে।
২০২১ সালের সম্ভবত মে মাসে নোয়াখালীর লক্ষীপুর অঞ্চলের এক খবর প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, স্ত্রী মারা যাবার পর বৃদ্ধ তাঁর সম্পত্তির সম্পূর্ণটা তিন পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেন। নিয়ম অনুসারে তাঁর সম্পত্তির একটি অংশ কন্যাকেও দিয়েছিলেন। তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে এক পুত্র বিদেশ থাকে আর অন্য দুই পুত্র দেশে সরকারি চাকুরি করে। তারা প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠিত এবং পিতার বরাদ্দকৃত জায়গায় স্বতন্ত্র বাড়ি করে দিন যাপন করছিল। একদিন শয্যাশায়ী পিতাকে একপুত্র বাড়ি থেকে উঠানে এনে রেখে দিয়ে অন্য দুই ভাইকে জানিয়ে দেয় যে, সে পিতাকে আর রাখতে পারবে না। একই সাথে অন্য দুই পুত্রও রাখতে পারবে না বলে নিজ নিজ ঘরের লোহার গেইট বন্ধ করে দেয়। উন্মুক্ত উঠানে প্রায় চার ঘন্টা পড়ে থাকার পর খবরটি এলাকায় জানাজানি হলে বোন এসে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি আনে। কিন্তু ইতিমধ্যে খবরটি প্রশাসনের গোচরীভূত হলে প্রশাসনের নির্দেশে পরবর্তীতে ভাইরা রাজি হয়। এভাবে সমস্যাটি সমাধান হয়। কিন্তু এ সমাধানটি তো এভাবে হওয়ার কথা ছিল না!
২০২১ সালের জুলাই মাসে খুলনার পাইকপাড়া উপজেলায় গদাইপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মেছের আলী (৯৫) আর তাঁর স্ত্রী সোনাভান (৮৬) বয়সের ভারে আর অসুখে তেমন হাঁটাচলা ও কাজকর্ম করতে পারেন না। এই দম্পতির চার ছেলে। সব জায়গা জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এখন কোন ছেলের ঘরেই আর আশ্রয় হয় না তাঁদের।
এ বিষয়গুলো সত্যিই অমানবিক। সন্তানদের কাছে পিতা-মাতাকে চালানোর যে সামর্থ নেই তা কিন্তু নয়। বরং দায়িত্ব নিতে চায় না। পিতা-মাতাকে সংসারের এক বিরাট বোঝা মনে করে। এ অমানবিক অবস্থা থেকে অবশ্যই আমাদেরকে পরিত্রাণ পেতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো নয়, বরং নিজ সংসারে পিতা-মাতাকে সাথে নিয়ে আনন্দে জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু কেমন জানি এ মনমানসিকতা ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। লেখাটির শেষ প্রান্তে এসে মন আমার গভীর বেদনায় ভরে গেল। তখন দূর থেকে নচিকেতার সেই গানের কলি কানে ভেসে এলো- ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী/ সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলে আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস তবারক হত্যাকাণ্ড ও কিছু স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধগাউসিয়া কমিটি পাঁচুরিয়া বাজার শাখার দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল