ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিসের চমকপ্রদ প্রথম বছর

নুজহাত নূর সাদিয়া | সোমবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

১টি বছর, ১২ টি মাস আর ৩৬৫ দিন একজনার কর্মযজ্ঞ বেশ সহজেই এক লহমায় গুণে ফেলা যায়। তবে, সাধারণের হিসাবের বাইরে মানুষটি যদি হয় ব্রিটেনের দন্ডমুন্ডের কর্তা বরিস জনসন, তাহলে আমাদের ভাবনার খোরাক ব্যতিক্রমী হতে বাধ্য বৈকি! ২৪শে জুলাই ২০২০ সাল,পূর্ণ হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনসন ও কনজারভেটিভ সরকারের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের বছর পূর্তি। ব্রেঙিট নামক সে দ্বিধান্বিত সিদ্ধান্তের অবশেষে শান্তিপূর্ণ বাস্তবায়ন, ক্ষমতার প্রথম বছরেই মহামারীর আক্রমণে সময়োচিত নানা আলোচিত-সমালোচিত সিদ্ধান্তের ভিড়ে দৃঢ় বরিস, এমনকি কভিড-১৯ এর আক্রমণে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে লড়াইরত বরিসের সুযোগ্য রাজনৈতিক উত্তরসুরি চ্যান্সেলর ঋষি সুনাকের সময়োপোযোগি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সংসদের হঠাৎ থমকে যাওয়া, স্পর্শকাতর রাশান প্রভাব, খরস্রোতা বন্যার তোড়ে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অংশের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়া,চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নিজ দলের সমর্থিত মানুষদের পাল্লা ভারি করা আর সর্বশেষ ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট- এ বিখ্যাত বাসভবনটিতে তিনি তাঁর ব্যতিক্রমী ইতিহাসটি লিখলেন, বাগদত্তা ক্যারি সিমন্ডসের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ফসল পুত্র সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে বিবাহ ুবহির্ভূত সম্পর্কটিকে স্বীকৃতি প্রদানের অভিপ্রায়ে।
নিঃসন্দেহে, ব্রিটেনের ৫৫তম প্রধানমন্ত্রী অনেক নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এবং বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চ আর ও কিছু নাটকীয় ঘটনার অপেক্ষায়!
কিছুটা পেছন ফেরা যাক, ব্রেঙিট নামক সে দীর্ঘ টানা পোড়েনের ব্যবচ্ছেদটি ব্রেঙিট শ্লোগানের সবচেয়ে সোচ্চার কন্ঠস্বরটি সময়ের পাতায় আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টেনে দিলেন অনেকটা একক সিদ্ধান্তে।
পূর্বসুরি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের স্থলাভিষিক্ত তিনি, দায়িত্বের লাগাম পুরোটাই তাঁর হাতে, প্রতিনিয়ত তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ;দ্বিধাগ্রস্তকারী,বিবাদকারী ও সংশয়ী শব্দগুলো! ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের শেষতারিখটি ছিল ৩১শে অক্টোবর, খোদ জনসন নিজে ও কি ভাবতে পেরেছিলেন এতটা প্রশ্নবিদ্ধ একটি চুক্তি নির্বিঘ্নে সারা সম্ভব? ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, প্রতিনিয়ত বাইরে সাধারণ বিক্ষোভকারী আর সংসদ কক্ষে ভিন্নমতাবলম্বীদের মুখোমুখি হচ্ছিলেন বরিস, নিজ দলের মোট ২১ জন এমপির অনৈক্য, একাধিক ব্যর্থ বৈঠক একরোখা মানুষটি হাল ছাঁড়লেন না, আম জনতার আস্থার প্রতিদান দিলেন ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে, দীর্ঘসূত্রতার গেরোটি অবশেষে ছিন্ন হল ৩১শে জানুয়ারি।
ক্ষমতার পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণের আগেই ঐতিহ্যগত দলটির অনুসারিটি চূড়ান্ত ক্ষমতার অপব্যবহার দেখালেন তেমন কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই দীর্ঘ সময় সংসদ অধিবেশন বন্ধ রেখে। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের সমালোচনা, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ, আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পাতার পর পাতা বিশ্লেষণী, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির উপর অবিচল আস্থা পাগলাটে বরিসের, রাণিমাতা দ্বিতীয় এলিজাবেথের উদ্বোধনী ভাষণকে সংসদে ফিরে আসার উপযুক্ত ঢাল মনে করলেন, তবে শেষ রক্ষা হল না। আবার ও আইনের শক্ত বেড়িটির মুখোমুখি তিনি, একটানা কর্মবিরতি, তাঁর এ একক সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা দিল সুপ্রীম কোর্ট। সাময়িক পরাজয়ের মুখোমুখি হলেন মধ্যবয়সী নেতাটি,তবে ভাগ্যদেবতা যে বিজয়ের তিলকটি তাঁর কপালেই পরাবেন বলে ঠিক করেছিলেন! হয়তবা, তাই মাত্র দু’মাস পরই রাজসিক ভাবেই রাণিমাতার ভাষণের মাধ্যমে ইতিহাসের ৫৫তম প্রধানমন্ত্রীটির পা পড়ল গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে।
দু’তৃতীয়াংশ হাউস অভ কমন্স সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন,অন্যদিকে ডানপন্থী ডিইউপির সাথে সমঝোতার চেষ্টাটি ব্যর্থ। পুরো ৫টি সপ্তাহ জুড়ে সরব প্রচারণা, বিরোধী লেবার প্রধান জেরোমি করবিনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার স্বপ্ন প্রায় ধূলিসাৎ, কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকলেন ১৯২৩ সালের পর প্রথমবারের মত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শতকরা মোট ৮০ ভাগ মেজরিটি জিতে।
বিজয়ের প্রথম বছর, দারুণ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন বরিস। কে জানত, মাত্র ক’টা মাসের ব্যবধানে করোনা নামক এক প্রাণঘাতী মহামারির সংক্রমণে পর্যুদস্ত বিশ্বের তাবত সরকারপ্রধানদের চিন্তিত মুখগুলোর সারিতে তাঁর মুখটা ও শোভা পাবে! গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মত, অদৃশ্য পরজীবীটি তাঁকে ও নাস্তানুবাদ করে ছাড়ল। তবে, ঐতিহ্যগত ভাবেই টোরি দল দেশপ্রেমের প্রতীক। তাই, পিলে চমকানো একের পর এক সরকারি অনুদান, নানা বিবেচনাধীন সুযোগ-সুবিধা আর ফারলো স্কীমের মত এক বিশাল সহায়ক বর্ম নিয়ে তিনি ও তাঁর সরকার এখন ও আগলে চলেছেন মন্থর অর্থনীতিতে দিশেহারা সন্তানপ্রতীম ব্রিটিশ জনগণকে। তবে, বোদ্ধাদের সমালোচনার তীর কিন্তু থেমে নেই, কাঙ্ক্ষিত সময়ের পরে লকডাউন জারি করা, পর্যাপ্ত পিপিইর অভাব, কেয়ার সেন্টারগুলোর অস্বাভাবিক মূত্যুর হার, বাজারে প্রতিষেধক আসা নিয়ে সময়ক্ষেপণ , লকডাউনের বেঁড়ি অমান্য করে কাউন্টি ডারহাম এ পা বাঁড়ানো একান্ত অনুগত ডমিনিক কামিংসের প্রতি নি:শর্ত সমর্থন ও তাঁর আকস্মিক পদত্যাগ নানা বিষয় নিয়েই এখন ও সংগ্রামমুখর তিনি।
প্রকৃতি, কেন জানি না বছর জুড়েই বৈরি আচরণের পরিচয় দিয়ে চলেছে পুরো বিশ্বব্যাপি। অবিরত বৃষ্টিপাত, ঝড়, পঙপালের শস্যক্ষেতে হানা দিয়ে যাওয়া আর কভিড-১৯ নামক সে দুষ্ট জীবাণুটি তো আছেই , ব্রিটেন ও রেহাই পায়নি এই দুর্যোগের কবল হতে। তবে, বন্যা কবলিত অঞ্চলগুলোতে বরিসের ত্রাণ সেবা আদৌ আন্তরিকতায় ভরপুর কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছে।
কভিড-১৯ এর জনক, তবে বিশ্বায়নের এ যুগে বাণিজ্য সম্রাট চীনকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ও আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা সময়ই বলে দিবে। ‘হুয়েই’ নামক চিনা টেলিকম ফার্মটির সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিটিতে সরকারি দলের একাংশকে সুযোগ করে দেওয়া, ব্রিটেনে সেবারত অন্যান্য টেলিকম কোম্পানিগুলোকে জোরপূর্বক তাদের ডাটা কেনার নির্দেশ প্রদান এসব কিছুই তাঁর পররাষ্ট্রনীতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। আইন ভঙ্গকারী ডমিনিকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, থেমে নেই আভ্যন্তরীণ উচ্চপদস্থ সরকারি কূটনীতিবিদদের চাপা অসন্তোষ, সবচেয়ে বড় চমক; বহু বছরের পরীক্ষিত বয়োজ্যেষ্ঠ কেবিনেট সচিব স্যার মার্ক সিডউইলকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করা হয় ব্রেঙিট লেনদেনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ডেভিড ফ্রস্টের আমন্ত্রণে।
বরিসের জন্য চূড়ান্ত বিস্ফোরণটি ছিল প্রকাশিত স্পর্শকাতর রাশিয়ান প্রতিবেদন যাতে বিগত ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত রেফারেন্ডামে তাদের গুপ্তচরবৃত্তির কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। ব্রিটেনের রাষ্ট্রনীতি প্রশ্নের মুখে পড়ে, উপরন্তু আছে সাম্প্রতিক অঙফোর্ড আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন নিয়ে রাশিয়ার উপর্যপুরি অনধিকার চর্চা। বরিস, সতর্ক হয়েছেন কি?
রাজনীতি, অর্থনীতির ডামাডোল আর প্রকৃতির বৈরিতা সব ছাপিয়ে তাঁর জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ ছিল একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের পিতা হওয়া। পুত্র উইলফ্রেড নিকোলাস লরি, কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ পিতা জনসন সন্তানের নামটি অলংকৃত করলেন করোনাকালে তাঁর সেবারত চিকিৎসক ও সেবিকাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে।
সবে দায়িত্বের শুরু, পথের এখন ও অনেকটা বাকি এত অল্প সময়ে এত ঘটনা, নানামুখী বৈচিত্র্য সংসদীয় ক্ষমতা পূর্ণ হতে বাকি প্রায় ৪টি বছর,তবে বোদ্ধা হতে জনগণ প্রত্যেকে সুনিশ্চিত ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বর্তমান অধিবাসীটি আর ও অনেক চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দিবেন।
ব্রিটেনের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আর নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে জানা যায়, কভিড -১৯ আক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীটি শারীরিক ভাবে এখন ও বেশ দুর্বল। চোখের দৃষ্টির অস্পষ্টতা তারই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, দ্বিধাবিভক্ত ব্রিটিশ জনতা আর বোদ্ধা রাজনীতিবিদদের জন্য ফাইজারের প্রতিষেধক হাতে পাওয়া বাজিকরটি চলতি ২০২০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর ব্রেঙিট বিচ্ছেদ নামক সে বহুল স্পর্শকাতর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির দাঁড়ি টানার অপেক্ষায়? বরিস, বিশ্বমঞ্চ কি আরেকটি কৌতূহুলোদ্দীপক ঘটনা প্রত্যক্ষ করবে। আমরা প্রস্তুত! (সূত্র বিবিসি)
এলবিপিসি, লন্ডন

পূর্ববর্তী নিবন্ধকন্যার বিয়ে যখন বাবার জন্য মানসিক চাপ
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্রগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি