নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে শীতলঝর্ণা খালে ধসে পড়া ব্রিজটির দুই পাশের ভিত্তি দেয়ালের (অ্যাবাটমেন্ট ওয়াল) মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল ৬ মিটার। এ অ্যাবাটমেন্ট ওয়াল ইট দিয়ে নির্মিত। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায় প্রতিরোধ দেয়াল দিয়ে শীতলঝর্ণা খালের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করে ১৩ মিটার করা হয়। কিন্তু সংস্কার করা হয়নি ব্রিজের, বাড়ানো হয়নি প্রশস্ততাও। ফলে সেতুর দৈর্ঘ্য খালের প্রশস্ততার সঙ্গে মেলেনি। অর্থাৎ ব্রিজের দৈর্ঘ্যের চেয়ে খালের গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় ভারী বর্ষণ হলে পাহাড়ি ঢলে সরে যায় দুই পাশের মাটি। এতে সেতুর ভিত্তি দেয়াল ভেঙে যায় এবং সেতুর একটি অংশ দুই ভাগ হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ব্রিজ ভেঙে পড়ার এ কারণ উঠে আসে। প্রতিবেদনে ব্রিজ পড়ার জন্য মোট চারটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে চারটি সুপারিশও করা হয়। এর আগে গত ৬ আগস্ট দিবাগত রাতে বায়েজিদ সড়কের স্টারশীপ ফ্যাক্টরি সংলগ্ন শীতলঝর্ণা খালের উপর ক্যান্টনমেন্ট থেকে অক্সিজেনমুখি এ ব্রিজটি ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ৭ আগস্ট প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। কমিটিতে চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিফাতুল করিম চৌধুরীকে সদস্য সচিব করা হয়। এছাড়া অন্য দুই সদস্য হলেন প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান। কমিটিকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর ১৪ তম দিনে গতকাল বুধবার চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় শীতল ঝর্ণা খালের ওপর নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে সেতুর নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ব্যয়ও ঠিক করা হয়েছে। যার পরিমাণ ৮ থেকে ৯ কোটি টাকা। নতুন সেতুর প্রশস্ততা হবে ২৩ মিটার। এর দৈর্ঘ্য ১৫ মিটার। আগে দৈর্ঘ্য ছিল ছয় মিটার। ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্রও আহ্বান করা হয়।
ব্রিজ ধসে পড়ার অন্যান্য কারণগুলো :
জানা গেছে, ব্রিজটি ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। ব্রিজের অঙিজেন থেকে ক্যান্টনমেন্টমুখি অংশ ২০১০ সালে সিডিএ নির্মাণ করে। ব্রিজ ভেঙে পড়ার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়, ব্রিজটির উত্তর পূর্বাংশে বায়েজিদ অঙিজেন এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি ড্রেন রযেছে। সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের আওতায় নির্মিত প্রতিরোধ দেওয়াল ও ভেঙে যাওয়া ব্রিজের ভিত্তি দেয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে ড্রেনের পানি সরাসরি বিজের ফাউন্ডেশনের পাশে নিষ্কাশিত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রিজ।
তৃতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়, ব্রিজ নির্মাণের সময় বায়েজিদ বোস্তামি সড়কে যে পরিমান গাড়ি চলাচল করত বর্তমানে তা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়েজিদ এলাকাটি শিল্প এলাকা হওয়াতে প্রতিদিন ভারী ট্রাক, লরি, কাভ্যার্ড ভ্যান এ সড়ক দিয়ে চলাচল করছে। অধিক ভারী বাহন চলাচলের কারণেও ব্রিজের ক্ষতি হতে পারে।
চতুর্থ কারণ হিসেবে বলা হয়, ওয়াসার ৯০০ মিলিমিটার ও ১২০০ মিলিমিটার ব্যাসের ২টি ট্রান্সমিশন পাইপ লাইন ভেঙে যাওয়া ব্রিজের পাশ দিয়ে গেছে। এখানে পাইপের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। পাইপলাইনের সুরক্ষা দিতে আরসিসি আরসিসি বঙ নির্মাণ করা হয়। এ বঙের ফাউন্ডেশন নির্মাণের সময় ব্রিজের ইটের ফাউন্ডেশন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
দুর্ঘটনা এড়াতে চার সুপারিশ :
নগরের অন্যান্য সেতুতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে চারটি সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে– এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ চিহ্নিত করে মেগা প্রকল্পের আওতায় খননকৃত খালের প্রস্থ ও গভীরতার সাথে মিল রেখে নতুনভাবে ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় সুপারিশে বলা হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক খালের পাশে একাধিক সংস্থা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করেছে। বিশেষ করে সিডিএ’র খাল খননের ফলে খালের গভীরতা বেড়েছে। এতে আগের প্রতিরোধ দেয়ালের তলদেশ থেকে মাটি সরে মাটি সরে বিভিন্ন স্থানে রিটেইনিং ওয়াল ভেঙে পড়ছে। রিটেইনিং ওয়াল সংলগ্ন সড়ক ধেবে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আশেপাশের স্থাপনাসমূহ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন প্রতিরোধ দেয়াল নতুনভাবে নির্মাণ করা প্রয়োজন। অন্যাথায় ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট হবে এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে।
তৃতীয় সুপারিশে বলা হয়, নগরের বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক ভারী যানবাহন চলাচল করছে। তাই অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ–কার্লভার্টের কালভার্টের তালিকা তৈরি করে তা ভারী যানবাহনের ভার বহনে সক্ষম করে তৈরি করা প্রয়োজন। এছাড়াও চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ–কার্লভার্টের সামনে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সাইনবোর্ড স্থাপনসহ এসব সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করার জন্য ট্রাফিক বিভাগকে অবহিত করতে হবে।
চতুর্থ সুপারিশে বলা হয়, ওয়াসা, গ্যাস, বিটিসিএল কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাইপ লাইন স্থাপন বা প্রতিস্থাপন কিংবা স্থানান্তর এর সময় সড়কে বিদ্যমান ব্রিজ–কালভার্ট বা ড্রেনের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান ড্রেনের মধ্যে ব্রিজের তলায় অথবা মাঝামাঝি স্থানে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের যে কোনো ধরনের পাইপলাইন স্থাপন থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে ড্রেনে ভিতর দিয়ে পানির সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত হবে। এক্ষেত্রে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সেবা সংস্থাসমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব কাজ করা হলে পরবর্তীতে কোনো রূপ ঝুঁকি সৃষ্টি হবে না।