অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে পত্রিকান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর্থিক খাতে ছিল ব্যাপক অনিয়ম। যেমন : ব্যাংক দখল করে মানুষের জমানো টাকা হাতিয়ে নেওয়া, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে কিংবা সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা বের করা, বাণিজ্যের ছদ্মবেশে অর্থ পাচার, ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দেওয়া, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক টিকিয়ে রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে ধস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে সবার আগে এই পচন থামাতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে, এই ১০০ দিনে যথেচ্ছ অনিয়মের সুযোগ বন্ধ করতে হয়েছে। এর ইতিবাচক ফলও এসেছে; কিন্তু সংকট পুরোপুরি কাটেনি। ডলার–সংকটের আপাত সমাধান হলেও ব্যাংকিং খাতে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা দূর করা যায়নি। বেসরকারি ৫–৬টি ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা এখনো চাহিদামতো টাকা তুলতে পারছেন না। এই ব্যাংকগুলো ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছিল। এসব ব্যাংকে অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আগের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল হয়েছে। কিন্তু তাদের তারল্যসংকট দূর হয়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে বেশ কিছু ব্যাংককে ধার দিয়ে আসছিল। নতুন সরকার গঠনের পর টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। তাদের টাকার জোগান দিতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এই ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলো চাহিদামতো টাকা ধার পাচ্ছে না। ফলে প্রয়োজন অনুসারে টাকা তুলতে না পারায় গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সার্বিকভাবে, ব্যাংক খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসেনি।’
সংকটে থাকা দেশের ব্যাংক খাতে অস্থিরতা যেভাবে তৈরি হয়েছে, তা দূর করা কষ্টসাধ্য। সরকার পতনের পর ব্যাংকে–ব্যাংকে আন্দোলন–বিক্ষোভ গোলাগুলিতে গড়িয়েছে। ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দাবিতে চলমান এই আন্দোলন নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন আমানতকারীরা। অনেক সঞ্চয়কারী শঙ্কায় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঝুঁকিতে এটিএম বুথে টাকা না পাওয়া,কয়েকটি ব্যাংকে নগদ টাকা উত্তোলনে সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে বিপাকে পড়েছে আমানতকারীরা। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে সংকট বাড়ার আশঙ্কাও করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। সেসময় একটি সুসংবাদ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না –আমানত সুরক্ষিত থাকবে’। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন খাত রয়েছে। তার একটি হলো ব্যাংক খাতের সংস্কার। এ খাতে প্রথমে আমরা দেশের রাষ্ট্রীয় এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পদ্ধতির উন্নতি করতে চাই। ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপি অনেক বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে আমরা কাজ করতে চাই। যে বড় বড় পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে সেগুলো কোথায় এবং কীভাবে দেওয়া হয়েছে, তা যাচাই করতে চাই। ব্যাংকগুলো নিজস্ব পরিচালনা কাঠামোর দুর্বলতা এবং সমস্যাগুলো সমাধান করতে চাই। ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফেরত আনতে চাই।
ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের আর্থিক খাতে যে বিশাল সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার সামাল দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পত্রিকান্তরে বলেন, ব্যাংক খাতে অনেক ধরনের ঝামেলা আছে। এত সমস্যা একসঙ্গে সমাধান করার মতো সক্ষমতাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। নীতি পরিবর্তন করায় ডলারের সংকট অনেকটাই কেটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনিয়মে জড়িয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভাঙার পর নিরীক্ষা করে এসব ব্যাংকের প্রকৃত তথ্য বের করার পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চয়ই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে, যা আমানতকারীদের জন্য ভালো হবে। লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো কি সত্যিই বন্ধ হবে না, নাকি এগুলো একীভূত করা হবে, নাকি মালিকানা বদল বা মূলধন জোগান দিয়ে শক্তিশালী করা হবে, সেই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তরও কেউ দিতে পারছেন না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন সরকারকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।