একটি দেশের অর্থনীতির গতিধারা নির্ভর করে উক্ত দেশের ব্যাংক খাতের ওপর। অর্থনীতিতে দুই ধরনের ব্যাংক কাজ করে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংক আর অপরটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সাধারণত সরকারের ব্যাংক হিসেবে মনে করা হয়। কারণ সরকার সব ধরনের আর্থিক লেনদেন এবং সমগ্র অর্থনীতিকে পরিচালিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর ভেতর দিয়ে। অবশ্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়াও অর্থনীতিতে আরো অনেক ধরণের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবকও হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে একটি অর্থনীতি পরিচালনা করার জন্য দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু বিগত সময় থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত মহা দুর্যোগের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ দুর্যোগ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দশকের পর দশক ধরে ব্যাংক খাতে এ বিশৃঙ্খলা চলে আসছে। এদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা বার বার তাগাদা দিলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে কারো কথা কর্ণপাত করা হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বিভিন্নভাবে বিভিন্ন গবেষণা পত্রে, বিভিন্ন প্রতিবেদনে এবং পত্র পত্রিকায় বিশেষ করে ঋণ খেলাপী সম্পর্কে এত প্রতিবেদন এবং লিখা সত্ত্বেও কর্তা ব্যক্তিরা কোনো কথাই আমলে নেয়নি। যার ফলে আজ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এক করুণ অবস্থা দেখা যায়। আজ এমন এক পরিস্থিতি উপনীত হয়েছে যে, বেশকিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যে কোনো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক যদি আজ বন্ধ হয়ে যায় তবে এদেশের দরিদ্র জনগণের কী পরিণতি যে হবে তা ভাষায় বলা যাবে না। আর এ অবস্থার প্রভাব সমগ্র অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো যে, শুধু একটি বা দুইটি নয়, প্রায় আট থেকে দশটি ব্যাংক এরূপ ভগ্ন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। একবার মনে মনে কল্পনা করুন তো– যদি আট থেকে দশটি ভঙ্গুর ব্যাংকের মধ্যে অন্তত চার বা পাঁচটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায় তবে লক্ষাধিক গ্রাহক তাদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে যাবে। ঘটনাটা এমন যে, হঠাৎ করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার মত। এ পরিবারগুলো অতি দরিদ্র শ্রেণিতে ঢুকে যাবে। তাদের আয় কমে যাবে। ব্যয়ের পরিমাণও কমে যাবে। ফলে পণ্য সামগ্রিক চাহিদাও হ্রাস পাবে। অর্থনীতি পতিত হবে গ্রেড ডিপ্রেশনে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির চলমান গতিধারা যে ক্রমশ উর্ধ্বগামী ছিল তা হয়ে যাবে নিম্নগামী। সমগ্র অর্থনীতি সেই কুড়েঘরে ঢুকে যাবে। হ্যাঁ, যদি ব্যাংক থেকে লুট করে নেয়া অর্থ দেশে থাকত তবে অর্থনীতিতে গ্রেড ডিপ্রেশন দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। কারণ অর্থ এক স্থান থেকে লুট হয়ে অর্থনীতির অন্যস্থানে বিনিয়োজিত থাকত। কিন্তু তা তো হয়নি। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে অর্থনীতি পড়েছে বিশাল বিপর্যয়ে। একটি জিনিস কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অর্থনীতিবিদরা ক্রমাগত সতর্কবাণী উচ্চারণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তাগাদা দিলেও বছরের পর বছর কেউ সেদিকে কর্ণপাত করেনি। উল্টো এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানী, দুর্নীতিবাজ আমলা, কতিপয় ব্যাংক মালিক, অধঃপতিত রাজনীতিবিদ, ধুরন্ধর ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসা ব্যবসায়ী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় প্ররোচনা ও ইন্ধনে অর্থনীতির প্রাণ এই ব্যাংক খাতটিকে ধ্বংস করার মহাযজ্ঞে কর্তৃপক্ষ কোনো বাধা তো দেয়নি বরং বলা যায় মদদ দিয়েছে। তাই আজ অর্থনীতি পড়েছে ঝুঁকিতে। কর্তৃপক্ষের গোচরে ব্যাংক দখল ও লুণ্ঠন, অর্থ পাচার এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে সীমাহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ একটা রেওয়াজের ভেতর দিয়ে অর্থনীতি এগিয়েছে। উন্নয়নও হয়েছে। তবে এ রেওয়াজ যদি বন্ধ করা যেতো অথবা প্রতিকার করা যেতো তবে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো দ্রুতগতি হতো। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ঘুষ, দুর্নীতি বলবৎ থাকা অবস্থায়ও বিশ্বের কোনো কোনো অর্থনীতি বিশেষ করে এশিয়ার কিছু দেশে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ১৯৯৬ থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে ব্যক্তি বিশেষ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে অসাধু লেনদেন বা অন্যায় সুবিধা দেওয়া বা নেওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করেও এশিয়ার নির্দিষ্ট কিছু দেশের মাথাপিছু গড় জিডিপি (Groos Domestic Product), আফ্রিকার সমমানের দেশগুলোর তুলনায় আট গুণ বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে ভিয়েতনামকে উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৬ সালে দেশটিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পর দেশটি দ্রুততম সময়ে দরিদ্র থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশে পরিণত হয়েছিল। ২০০২ থেকে পরবর্তী ১৬ বছরে ভিয়েতনামের দারিদ্র্যমুক্ত মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে চার কোটি। দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ৬ শতাংশের নিচে নেমে যায়। মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছিল আড়াই গুণ। এ কারণে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অনাকাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রবৃদ্ধির সহঅবস্থানের একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ আছে। সরকারি নিয়মনীতি যখন বিনিয়োগ তথা প্রবৃদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে সে সব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হলে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়তে পারে। ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠিত রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যদি দক্ষভাবে বিনিয়োগ করা যায় তবে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। এজন্য বলা হয় যে, সামান্য মাত্রায় দুর্নীতি কিছু দুরুহ সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। ১৯৮৪ থেকে ২০১৬ সালের উপাত্ত ব্যবহার করে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ সর্বাণী সাহা ও কুনাল সেন এ ধারণা প্রদান করেন যে, দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে উন্নয়ন ও দুর্নীতি পরস্পরের সহযোগী। তবে এই গবেষণা প্রসূত বক্তব্যকে কোনোক্রমেই দুর্নীতির পক্ষাবলম্বন বলে ধারণা করা যাবে না। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন মাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের শিক্ষক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিউদ্দিন মাহমুদ (বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা) বহু আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন যে, নির্দিষ্ট মেয়াদের পর কোনো সরকারের শাসনকাল শেষে নতুন সরকারের আমলে অর্থনীতি থাকে বিপর্যস্ত। যদি একই সরকারের শাসনকাল দীর্ঘায়িত হয় তবে অর্থনীতির ধারকেরা হয়ে উঠে একচ্ছত্র ও অপ্রতিরোধ্য। ঠিক একই অবস্থা চলছিল বাংলাদেশে। ২০০৮ সালের ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর সাথে অপ্রদর্শিত, পুনঃতফসিল, আদালতের আদেশে স্থগিত এবং অবলোপন করা খেলাপী যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের এ বিপর্যস্ত অবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কোথায় যে নিয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যে কোনো প্রকারে হোক বর্তমানে দুর্বল ব্যাংকগুলো সচল করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম কাজ হওয়া উচিত। একই সাথে খেলাপী ঋণ উদ্ধার করা এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনাই হবে বর্তমান অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক;
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক– ইউএসটিসি।