একটি অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। যে কোন দেশের অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে দুই ধরনের ব্যাংক বিদ্যমান থাকে। এদের একটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা সরকারের ব্যাংক হিসেবে কাজ করে এবং অর্থনীতির সামগ্রিক আর্থিক নীতি পরিচালনা করে। অপরটি হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংক। একটি অর্থনীতির সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সরকারের আর্থিক নীতি দ্বারা পরিচালিত হয় যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। অপরপক্ষে বাণিজ্যিক ব্যাংক হচ্ছে এমন ব্যাংক যা জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে এবং অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য আবার জনগণকে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। এ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে কতগুলো বিশেষায়িত ব্যাংকও রয়েছে, যার মাধ্যমে সরকার বা উক্ত ব্যাংক বিশেষ বিশেষ খাতে ঋণ প্রদান করে থাকে। যেমন– বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিলুপ্ত) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ইত্যাদি। এ ছাড়াও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরো কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক না হলেও জনগণের সাথে অর্থ লেনদেন করে থাকে। যেমন আইডিএলসি, ডিবিএইচ, কো–অপারেটিপস ব্যাংক, বীমা কোম্পানীগুলো, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীগুলো ইত্যাদি। এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতিতে তেমন ভূমিকা না রাখলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে বেশি। আবার কিছু কিছু বিদেশি ব্যাংকও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাজ করে। যেমন– হাবিব ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ট ব্যাংক ইত্যাদি। এসব ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না। তাছাড়া এ ব্যাংকগুলোর শাখা শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে এসব ব্যাংকের পদচারণা নেই বললে চলে। সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আছে সরকারি মালিকানাধীন। যদিও এ ব্যাংকগুলোকে পাবলিক ইলিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তর করা হয়েছে তবুও এসব ব্যাংকের দায় দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হয়। এ ব্যাংকগুলো হয় সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, এর বাইরেও কয়েকটি সরকারি বা আধা সরকারি ব্যাংক রয়েছে। যেমন– বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক লিমিটেড এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এ সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ অর্থনীতির আর্থিক ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ অর্থনীতির আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠির নিকট থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং নিয়োগকৃত কর্মকর্তা পাঠিয়ে তদবির করে, ভালো ব্যাংক বলে প্রচারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা জনপদের নিকট থেকে আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ সুযোগে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকেরা নামে, বেনামে, ভূয়া নামে উক্ত ব্যাংক থেকে লোন হিসেবে নিয়ে আর পরিশোধ করছে না। এমনকি নামে মাত্র শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন কারসাজি করে লোন প্রদানের যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘বিশেষ বিবেচনায়’ লোন প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, লোন গ্রহণকারী শিল্প কারখানার মারিকেরা লোন আর ফেরৎ দেয়নি। হয়ে গেছে ‘ঋণ খেলাপী’। আবার কোন কোন ঋণ গ্রহীতা ঋণ গ্রহণের বিপরীতে যে জামানত দেখিয়েছে তা ভূয়া বা লোন গ্রহণের একশত ভাগের এক ভাগ হয় জামানত। সোনালী ব্যাংকের মত বৃহৎ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকেরও হাজার হাজার কোটি টাকা হয়ে গেছে ঋণ খেলাপী বা মন্দ ঋণ। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কিছু ঋণগ্রহণকারী যথাযথ নিয়মে ঋণ পাওয়া সম্ভব নয় বলে বিশেষ বিবেচনায় হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে সোজা চলে গেছে বিদেশে। গড়ে তুলেছে দুবাই বা আমেরিকা বা কানাডার বেগম পাড়ায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা। তারা এখন আর দেশে আসে না। ফলে বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক হয়ে গেছে দুর্বল। তার মধ্যে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নাম ফারমাস ব্যাংক। এ ব্যাংকে যখন অচল অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন মৃত সঞ্জীবনী পান করিয়ে এ ব্যাংকের নতুন নাম রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে ‘কোরামিন’ হিসেবে ‘এক্সিম ব্যাংক’ এর সাথে একীভূত করা হয়।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে ‘একীভূত’ একটি নতুন শব্দ সংযোজন হলো। একটি ব্যাংক যখন মৃতপ্রায় হয়ে যায়, তখন ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য আর একটি সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করা হয়। অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে আগেও একটি ব্যাংক একীভূত হওয়ায় নজির রয়েছে। আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে দেশের দুইটি বিপর্যস্ত ব্যাংক একীভূত করা হয়। ব্যাংক দুইটি হয়– বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা। এই দুইটি ব্যাংককে একীভূত করে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড। সংক্ষেপে বলা হয় (বিডিবিএল)। ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি একীভূত ব্যাংক হিসেবে বিডিবিএল যাত্রা শুরু করে। সম্প্রতি প্রকাশিত এ তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪৬ শতাংশ বা ৮৮৯ কোটি টাকা খেলাপী। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি খেলাপী ঋণের পরিমাণ হয় ৯৮২ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। আরো জানা যায়, ২০২২ সালে ঋণ দিয়ে ও আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করার পর ব্যাংকটি যে পরিমাণ আয় করেছে, তার প্রায় দ্বিগুণ এসেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে। ঐ বছর ব্যাংকটির নিট সুদ আয় হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে শেয়ার বাজার থেকে আয় এসেছে ৭৫ কোটি টাকা। আর একই বছরে ভবন ভাড়া থেকে আয় এসেছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। বিডিবিএল ব্যাংকর ঢাকার মতিঝিল ও কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রাম ও খুলনায় কয়েকটি বহুতল ভবন রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকটির ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঝিনাইদহ ও রাজশাহীতে মোট ২৭ বিঘা জমি রয়েছে। এখান থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে ব্যাংকটি কোন রকমে চলছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে, বেশ কিছু বাণিজ্যিক দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংক এর সাথে একীভূত করবে। এ একীভূতকরণ সাক্সেস করার জন্য বাংলাদেশে বর্তমান কার্যক্রম চালিত ব্যাংকগুলোকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। অতি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রাখা হয়েছে রেড জোনে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রাখা হয়েছে ইয়েলো জোনে এবং তুলনামূলক সবল ব্যাংকগুলোকে রাখা হয়েছে গ্রীণ জোনে। কোন কোন ব্যাংক কোন জোনে অবস্থান করছে তা একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে একটি ফিন্যানসিয়াল পত্রিকা। উক্ত পত্রিকার তথ্যকে যদি সঠিক ধরে নিই, তবে দেখা যায়, অতি দুর্বল পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করা হয়েছে, ইয়েলো জোনে থাকা এঙ্মি ব্যাংক এর সাথে। চলতি বছরের মধ্যে আরো কয়েকটি ব্যাংক একীভূত হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে। এরপর থেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে তথা আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরণের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্বল ব্যাংকের সাথে অপেক্ষাকৃত সবল (ইয়েলো) ব্যাংককে যদি একীভূত করা হয়, অথবা দুর্বল ব্যাংককের সাথে সবল (গ্রীন) ব্যাংককে একীভূত করা হয় তবে দুর্বল ব্যাংককে আমানতকারীদের কী হবে। তারা তাদের আমানতকৃত কষ্টার্জিত অর্থ ফিরে পাবে কি? অথবা সকল (গ্রীন) বা অপেক্ষাকৃত সবল (ইয়েলো) ব্যাংককে রাখা আমানতকারীদের অর্থ আমানতকারী যথাযথ সময়ে ফেরৎ পাবে কী? এ প্রশ্নের উত্তর কোন কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে বলছে না। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত হওয়ায় একটি নীতিমালা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জারী করে। এ নীতিমালাটি হয় ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ। ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চে একটি কার্যকর হবে। পিসিএ নীতিমালায় বলা হয়েছে, পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর শ্রেণি নির্ধারণ করা হবে। এই পাঁচটি সূচক হয়, ১। ব্যাংককের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত, ২। টিয়ার–১ মূলধন অনুপাত। অর্থাৎ শেয়ারধারীদের মূলধন, যা ব্যাংককের মূলধন ও মুনাফা থেকে রেখে দেয়া অর্থের সমষ্টি, ৩। কমন ইকুইটি টিয়ার–১ (সিইটি–১) অনুপাত। অর্থাৎ পারপিচুয়াল বন্ড। এ বন্ড বাজারে ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যাংক। অবশ্য বন্ড ক্রেতাদের প্রতি বছর মুনাফা দেয়া হয়। ৪। প্রকৃত ঋণ খেলাপী, ৫। কর্পোরেট গভর্ন্যান্স বা সুশাসন। বাংলাদেশ ব্যাংককের নীতিমালা থেকে জানা যায়, আগামী ডিসেম্বর ২৪ পর্যন্ত ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। যদি স্বেচ্ছায় একীভূত না হয় তবে ২০২৫ সালে মার্চ মাস থেকে নীতিমালা অনুযায়ী দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এতে আমানতকারীদের কোন শঙ্কা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের আশ্বাস, আমানতকারীদের শঙ্কামুক্ত হবার জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন দেশের আর্থিক ব্যবস্থার অভিভাবক, তেমনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ কর্তা। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে অবশ্যই আমানতকারীদের অর্থের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংককের অনুমোদন ক্রমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে এবং পরিচালিত করছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি