ব্যাংক একীভূতকরণের অযৌক্তিকতা দৃশ্যমান নয় কী?

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১১ মে, ২০২৪ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

অতিসম্প্রতি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে নতুন করে উদ্বেগউৎকন্ঠা নির্মিত হয়েছে। বিজ্ঞজনদের প্রায় সকলেই ব্যাংক একীভূতকরণে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছিলেন। বিভিন্ন লেখালেখিবক্তব্য প্রদানে তাদের মতামত এর বিরুদ্ধেই ছিল। গ্রাহক হয়রানির ভয়ঙ্কর আশঙ্কা প্রতিফলিত হয়েছিল প্রায় প্রতিটি বার্তায়। অর্থনীতিবিদরা এই প্রক্রিয়াকে ‘ফোর্সড ম্যারেজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে খারাপ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক একীভূত হওয়ার পাঁচ বছর পর পুনরায় পরিচালক হতে পারার এই বিধানের সমালোচনা করেন তারা। এছাড়াও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তাকর্মচারীদের ছাঁটাই করার আশঙ্কাসহ বিভিন্ন অনিশ্চয়তা থাকায় এই প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। নীতিমালায় স্বেচ্ছায় ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা থাকলেও; বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক তা না মানার অভিযোগ উত্থাপিত। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পথনকশা দেওয়ার পর ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিছুটা সবল ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে দুর্বল ব্যাংকের বোঝা।

ইতিমধ্যে সরকারিবেসরকারি ১০টি ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হলেও; আপাতত আর কোনো ব্যাংককে একীভূত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র গণমাধ্যমে বলেন, ‘এই পাঁচ ব্যাংকের বাইরে এখন নতুন করে আর কোনো ব্যাংককে স্বেচ্ছায় একীভূতকরণ করা হবে না। কারণ এ বিষয়ে আমাদেরও কতটা সক্ষমতা আছে, এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি ব্যাংক নিরীক্ষা করতে তিনটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান লাগবে। দেশে ভালো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে। এই পাঁচ ব্যাংক থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনের দিনে আরও ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত করতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অডিটর নিয়োগ, সম্পদ ও দায় ঠিক করা, শেয়ার দর ঠিক করা, শেয়ার অংশ নির্ধারণও আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এতে সময় লাগবে। এই পাঁচ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) অভিজ্ঞতা নেবো। অভিজ্ঞতরও প্রয়োজন আছে।’ যদিও সংস্থাটির অপর কর্মকর্তার দাবি, দেশে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ব্যাংকগুলোর মালিকদের অধিকাংশই প্রভাবশালী। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া তাদের চাপেও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

জনশ্রুতি মতে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ভীত গ্রাহকদের আমানত তোলার হিড়িকসহ নানামুখী প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত একীভূতকরণ থেকে সরে এসেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেশকিছু ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানত ব্যাপকভাবে তুলে নেওয়ার সংবাদ পরিবেশিত। ১৮ মার্চ ২০২৪ দুটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে একীভূতকরণের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর নিরাপত্তাআস্থার অভাবে গ্রাহকদের ব্যাংক দুটি থেকে টাকা তুলার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সিটি ব্যাংকের সাথে বেসিক ব্যাংকের এতীভূতকরণের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই বেসিক ব্যাংকের বড় বড় আমানতকারীরা আমানত তুলে নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে চিঠি দিয়েছে। ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমাদের বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মার্জার সিদ্ধান্তের ফলে গ্রাহকরা ডিপোজিট তুলে নেয়া শুরু করেছে। এতে আমাদের তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা সার্বিক এই ক্ষতির বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবো।’

একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে চলা অপর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) এবং কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হতে যাওয়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকেও গ্রাহকদের আমানত তুলে নেয়ার চিত্র দৃশ্যমান। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহের কর্মকর্তাদের মতে, হঠাৎ গ্রাহকদের এভাবে আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সংকট আরও বাড়বে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালকের ভাষ্য, ‘তুলনামূলক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে সাধারণ আমানতকারীসহ অনেক ব্যাংকের পরিচালকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কারণ ভালো ব্যাংক যেগুলো আছে, সেগুলো তো নিয়মকানুন মেনে, কমপ্লায়েন্স মেনে, নানা ধরনের প্রতিকূলতা পার করে ভালো হয়েছে। ফলে তারা কেন একটি দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নেবে?’

পক্ষান্তরে ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক শুরু হলেও দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ মন্দ ঋণ বা খারাপ সম্পদের সমন্বয় প্রক্রিয়া এখনো অস্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ ক্ষেত্রে দ্রুততর সময়ের মধ্যে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণের চাপে ভালো ব্যাংকও নুয়ে পড়তে পারে। চলতি বছরের মার্চ মাসে পদ্মা ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার ঘোষণা দেয় এক্সিম ব্যাংক। তুলনামূলকভাবে এক্সিম ব্যাংক ভালো হলেও অনিয়মঋণ কেলেঙ্কারি ও সুশাসনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যউপাত্তে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এছাড়াও ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশ অবলোপন খাতায় যুক্ত আছে। ঋণের মধ্যে আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ৬০৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের বিতরণ করা ৪৬ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ব্যাংকটির আদায় অযোগ্য ঋণ ১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির কোনো মূলধন ঘাটতি নেই। উভয় ব্যাংকেরই অধিক পরিমাণ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এই অবস্থায় ব্যাংক দুটি একীভূত হওয়ার পর এক্সিম ব্যাংকের খেলাপির হার দাঁড়াবে মোট ঋণের ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যদিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যাংকের খেলাপি থাকতে হবে ৫ শতাংশের নিচে। বিজ্ঞজনের মতে, জোর করে একটা ব্যাংককে অন্য একটা ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করে দিলে তো ব্যাংক খাতের মূল সমস্যার সমাধান হবে না। খেলাপি ঋণে জর্জরিত পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা হচ্ছে। যেসব পরিচালকের কারণে পদ্মা ব্যাংকের আজকের এ পরিণতি তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি না মেনে বাংলাদেশ ব্যাংক জোরপূর্বক তড়িঘড়ি করে মার্জ করে দিচ্ছে। এতে আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন। পুরো ব্যাংক খাতে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ব্যাংক সমূহের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ জন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুরও পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি একই ধরনের নির্দেশনা দেন। উক্ত বৈঠকে তিনি চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। একই মাসে বেসরকারি ব্যাংক এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের পর ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংকের ও ৯ এপ্রিল শুরু হয় ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাথে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া। সিদ্ধান্তটি এখনও কার্যকর হয় নি এবং একীভূত না হওয়ার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত।

অতিসম্প্রতি অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ব্যাংক একীভূতকরণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত করা সব দেশেই হয়। জোর করে ব্যাংক একীভূত করা যাবে না। দুই পক্ষের সম্মতিতে এটা করতে হবে। কিন্তু খারাপ ব্যাংক ভালো করার একটাই একমাত্র উপায় না। এর বিকল্প আছে। এখন যাদের ভালো ব্যাংক বলা হচ্ছে, এমন চারটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকই একসময় তদারকি করে ভালো করেছে। একমাত্র সরকারি ব্যাংক হিসেবে বেসিক ব্যাংক একসময় সরকারকে মুনাফা দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা তৈরি করা। ধীরে ধীরে ব্যাংকটি খারাপ করে ফেলা হয়েছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সৃষ্টি করা হয়েছিল উত্তর বাংলার কৃষিকে জোরদার করার জন্য। এখন এক করা হলে উত্তর বাংলার কৃষি বেকায়দায় পড়তে পারে। বিডিবিএলকে একীভূত করা ঠিক হবে না। প্রকল্প ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকটির প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা ভেবে দেখতে পারে।’

সার্বিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, কোনো ধরনের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গভীর যাচাই বাছাই ছাড়া দুর্বল ব্যাংকসমূহকে ভালো করার সুযোগসময় বেঁধে না দিয়ে দ্রুততর সময়ের মধ্যে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া মোটেও বোধগম্য নয়। গ্রাহক হয়রানির সাথে ব্যাপক গণরোষ সৃষ্টির বিষয়টিও আমলে নেওয়া দরকার। দেশে নানামুখী অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অংশ কিনা তারও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মোদ্দাকথা দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে কোনভাবেই জনদুর্ভোগকে মেনে নেওয়া যায় না। বরং জনকল্যাণে সমুদয় ব্যাংকিং খাত যথার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক এটুকুই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় শিক্ষক সমিতির ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন