দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের চেহারা পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যে গৃহীত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাড়ছে নির্মাণ ব্যয়। প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিসহ টেকনিক্যাল কিছু কারণে প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রকল্পের মেয়াদকালও ৩ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দরটি পুরোদমে চালু করতে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আজ সোমবার সকালে নৌপরিবহন উপদেষ্টা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিদর্শনে যাচ্ছেন। তিনি প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, মাতারবাড়িতে ১২শ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে জাপানের আর্থিক সহায়তায়। জাইকা এ কেন্দ্রের কারিগারি এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পনি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছে। ১২শ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। দুই মাসের প্রয়োজনীয় অন্তত ৬ লাখ টন কয়লা এখানে মজুদ রাখা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রয়োজনীয় জ্বালানির যোগান দিতে বিদেশ থেকে প্রতি মাসে অন্তত তিন লাখ টন কয়লা আমদানি করতে হবে। একেকটি জাহাজে ৬০ হাজার টন কয়লা পরিবহন করলেও মাসে অন্তত ৫টি মাদার ভ্যাসেল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য হ্যান্ডলিং করতে হবে। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং কয়লা আমদানির পথ তৈরি করতে ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চ্যানেল তৈরি করতে হয়। ২৫০ মিটার প্রস্থের ও ১৬ মিটার গভীর এই চ্যানেল ধরে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট এবং বিপুল পরিমাণ কয়লাও আমদানি করা হয়। এই চ্যানেল তৈরি করার সময় জাইকার একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে বলে, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর করা যায়। পুরো বিষয়টি তুলে ধরে তারা জানায়, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার গভীর এবং ২৫০ মিটার প্রস্থ যে চ্যানেলটি তৈরি করা হয়েছে সেটিকে যদি পাশে ১০০ মিটার বেশি প্রস্থ করে ৩৫০ মিটার এবং গভীরতা ২ মিটার বাড়িয়ে ১৮ মিটার করা হয়, তাহলে এটি গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তারা গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হলে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন নামে আলাদা একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
শুরুতে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প নামের প্রকল্পটি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু হয়। সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বর্ধিত করে ৩৫০ মিটারে উন্নীত করা হয়। গভীরতাও ১৮ মিটার (এমএসএল) করা হয়েছে। নির্মিত চ্যানেল ও হারবার নিরাপদ ও সুরক্ষিত করার জন্য সিপিজিসিবিএল কর্তৃক ১,৭৫৩ মিটার উত্তর ব্রেকওয়াটার, ৭১৩ মিটার দক্ষিণ ব্রেকওয়াটার এবং উত্তর দিকে ১৮০২.৮৫ মিটার রিভেটমেন্ট নির্মাণ করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে এসব কার্যক্রম শুরু হয়। জাপানের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পের খরচ যোগান দিতে থাকে। প্রকল্পটির জন্য জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা ঋণ সুবিধা প্রদান করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার এবং সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা মিলে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করা হয়। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু প্রকল্প গ্রহণের পরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খরচ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং আনুষঙ্গিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যয় পুনঃনির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ব্যয় সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। সময় রাখা হয় ২০২৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার সংশয় প্রকট হয়। নতুন করে প্রকল্পের সময় নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। নতুন প্রস্তাবনায় ২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে। একইসাথে প্রকল্প ব্যয়ও প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। জাইকা এই বন্দরে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে চ্যানেল ও জেটি নির্মাণ করা হয়েছিল তা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করেছে সিপিজিসিবিএল। একইসাথে ওই চ্যানেল ও জেটি নির্মাণে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে তার দায়ও বন্দর কর্তৃপক্ষের উপর তুলে দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় শুরু হবে ২০২৬ সালে। বন্দর পুরোদমে চালু না হলেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকার যোগান দিতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ইতোপূর্বে জানিয়েছিল।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি পুরোদমে চালু করতে হলে এখন নতুন করে ঋণ নিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় নিয়ে নতুন করে আলোচনা করা দরকার বলে মন্তব্য করে সূত্রগুলো বলেছে, বন্দর চালু হওয়ার আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বেকায়দায় পড়ে যাবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন আজ সকালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিদর্শন করবেন। তিনি কঙবাজার হয়ে মাতারবাড়ি যাবেন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা কঙবাজারে অবস্থান করছেন। নৌপরিবহন উপদেষ্টা গভীর সমুদ্রবন্দর পরিদর্শন এবং প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।
বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক কঙবাজারে অবস্থান করছেন জানিয়ে বলেন, মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয় মাতারবাড়ি পরিদর্শন করবেন।
উল্লেখ্য, দেশের প্রথম এবং একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দরে যে কোনো দৈর্ঘ্যের ও ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ হ্যান্ডলিং করা যাবে।