আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গ্যারান্টিকে সেকেলে প্রথা হিসেবে দেখা হয়। ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যক্তিগত গ্যারান্টির প্রচলন উঠে গেছে বহু আগেই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত জামানত না থাকলে ঋণগ্রহীতার গণহারে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার পাশাপাশি তাঁর পিতা–মাতা, স্ত্রী–সন্তান, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া–প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও গ্যারান্টি নেয়া হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানও। আর কোন কারণে গ্রাহক ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টারদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে মামলা। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে এখবর প্রকাশিত হয়।
আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ ব্যাংক জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সেকেলে প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত গ্যারান্টির প্রথা চালু রেখেছে। উন্নত দেশগুলো বহু আগেই এ প্রথা রহিত করেছে। অথচ আমাদের এখানে এটা চালু থাকায় গ্যারান্টারদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লিখিত প্রতিবেদনেই তা বলা হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি সহ্য করা যায় কিন্তু মানসম্মান বিনষ্ট হওয়া, বা কারাভোগ করা কোনমতেই সহনীয় নয়। মানুষের মানইজ্জতটাই সবচেয়ে বড়। এমন পরিস্থিতিতে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের একটি আধুনিক ও সুষ্ঠু পরিপূর্ণ গাইডলাইন প্রয়োজন, যাতে ঋণগ্রহীতা হয়রানির শিকার না হন, আবার ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। কোনো কোনো ব্যাংক ঋণগ্রহীতার আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করা থেকে শুরু করে সামাজিক অবস্থানও বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এজন্য নির্ধারিত ফরম ও প্রক্রিয়া থাকে। তাছাড়া ঋণ গ্রহীতার কিছু বিষয়ও যাচাই করা হয় তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে। ব্যাংক ঋণের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এসব নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য হলো ঋণকে নিরাপদ রাখা। তবে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা ও জামানত গ্রহণের নীতিমালার বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনতা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো নিজেদের জন্য প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতেই ঋণের জামানত ও গ্যারান্টি গ্রহণ করে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে বৈশ্বিকতার জামানত গ্রহণ ও করপোরেট গ্যারান্টির প্রচলন আছে। তবে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বর্তমানে জামানত গ্রহণের নীতিকেও সেকেলে ধারণা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে ব্যাংক ঋণ নেয়ার জন্য জমি বা বাড়ি বা স্থাবর সম্পত্তি জামানত রাখার প্রয়োজন হয় না ব্যাংক থেকে নেয়া অর্থ ফেরত দেয়া হবে এ প্রতিশ্রুতিই সেখানে বড় জামানত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি জামানত, করপোরেট গ্যারান্টির পাশাপাশি ব্যক্তিগত গ্যারান্টিও আদায় করছে।
ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্যারান্টি একটি কার্যকর প্রক্রিয়া। প্রতিটি দেশেই এটি প্রচলিত। তবে বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। বড় বড় গ্রাহকের ক্ষেত্রে জামানত ছাড়াই শুধু পরিচয়ের সূত্র বা সুনামের ওপর ভর করেই কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলেও গবেষণায় বলছে। কোনো কোনো কোম্পানিকে জোর করে ঋণ দেয়ার উদাহরণ আছে। এক্ষেত্রে শিশু সন্তান থেকে শুরু করে বন্ধু, আত্মীয়, এমনকি অফিসের সহকর্মীকে গ্যারান্টার করা হচ্ছে। কোনো ঋণগ্রহীতা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টার বাড়তি ঝামেলায় পড়ছেন। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আধুনিক এ সময়ে ব্যাংক ঋণের গ্যারান্টার জোগাড় না করে বীমার সহায়তা নেয়া যেতে পারে। ঋণের বিপরীতে বীমা বাধ্যতামূলক হলে ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংক উভয়ের জন্য লাভজনক হবে। এছাড়া ঋণ দেওয়ার আগে ব্যক্তিগত প্রোফাইল যাচাইয়ে তৃতীয় পক্ষকে সংযুক্ত করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে ঋণ দেয়া ও আদায়ে এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এতে ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। একই সঙ্গে ঋণ প্রদান ও আদায় সহজ হয়ে উঠবে। ঋণের অর্থের ব্যবহারও তদারকির আওতায় আনা যাবে।
আধুনিক সময়ের সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে ব্যাংকের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনায় এ পরিবর্তন আসতে হবে। আমাদের আইন, বিধিমালাও পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতে এখন ব্যাসেল–৩ বাস্তবায়ন হচ্ছে। অথচ আমাদের ঋণ প্রদান ও আদায়ে এখনো সেকেলে ধারণা বিদ্যমান, যার পরিবর্তন প্রয়োজন। জামানতসহ বা জামানতবিহীন ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন থাকা দরকার। আমাদের প্রত্যাশা, গ্রাহক হয়রানি ও ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আধুনিক সময়ের উপযোগী একটি গাইডলাইন দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এ কারণে দেশে আন্তর্জাতিক মানের আদর্শ ব্যাংকিংয়ের চর্চা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণ খেলাপিদের বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে এদেশে ক্রিমিন্যাল হিসেবে সম্বোধন করা হয় না। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন লাগবে। ঋণ খেলাপিদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘদিন থেকেই ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রচলিত আইন ও রীতিনীতি দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থেই এমন অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন।