অবশেষে জয় হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–ছাত্রীদের। জয় হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। জয় হলো ছাত্র, জনতা ও তরুণ সমাজের। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। নিহত হয়েছে অনেকে। এ পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার–উজ–জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সব হত্যার বিচার হবে। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখেন। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখেন, একসাথে কাজ করি।’
সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর বক্তব্যে যেহেতু দাবি পূরণ হয়ে গেছে সেজন্য ছাত্রজনতাকে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, দেশে যা ঘটল, এটাই হওয়ার কথা ছিল। গণ–অভ্যুত্থান কখনো ঠেকানো যায় না। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সহজেই সমাধান করা যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদের কারণে এত মানুষ মারা গেল। গণমাধ্যমে প্রাণহানির যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আরও কত মরদেহ কোথায় পড়ে আছে, কত গণকবর হয়েছে, কতগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরেছে! তিনি তো চলে গেলেন। এখন এর জবাব দেবে কে? ১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেননি। দিনের পর দিন ভোট চুরি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শেখ হাসিনার বোঝা উচিত ছিল, তিনি ও তাঁর দল কতটা অজনপ্রিয়। এই যে এত প্রাণহানি, এর জবাব দেবে কে? দেশে সুশাসনের মারাত্মক অভাব। তিনি সুশাসন দিতে পারেননি।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের একদিন আগে প্রকাশিত তাঁর একটা লেখায় লিখেছেন, ‘এমন মাৎস্যন্যায়ের ভেতর দেশের ছাত্রসমাজ বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা ঘটাল। তাদের দাবি আদৌ অযৌক্তিক ছিল না। সরকার যে তাদের দাবি এত চটজলদি এবং প্রায় পুরোপুরি মেনে নিল, এটাই প্রমাণ করেছে ছাত্র সমপ্রদায়ের দাবি কতটা যৌক্তিক ছিল। সরকার প্রথমেই ছাত্রদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলাপ–আলোচনা করে এর একটা সমাধান অনায়াসে বের করতে পারত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই, মহাভারতের কর্ণের মতো, জীবনের সঙ্গিনতম মুহূর্তে নিজের সবচেয়ে অমোঘ অস্ত্রটির কথা ভুলে যায়। দীর্ঘদিনের ক্ষমতার প্রতাপ, শক্তির দম্ভ ও অহমিকার কারণে তাঁরা সম্ভবত সে পথ নেননি। তাঁরা বেছে নিলেন শক্তি ও বলপ্রয়োগের মাধ্যম।’ সরকারের অবহেলাকে তিনি দায়ী করেছেন। বলেছেন, ‘সাময়িকভাবে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও দেশজোড়া দুর্নীতি আর লুণ্ঠনের ফলে মানুষের বুকের ভেতর দীর্ঘদিন ধরে যে ক্ষোভ, বেদনা, ঘৃণা ও আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, তাকে মুছবে কে? জাতীয় কল্যাণকে আর অহমের দাস করে রাখবেন না। গণতন্ত্র চিরকালই সহযোগিতার, সৌহার্দ্যের– তার এই মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখুন।’
জাতিসংঘও সহিংসতা বন্ধে সোচ্চার ছিল। বাংলাদেশে মর্মান্তিক সহিংসতা বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও হুকুমের দায়দায়িত্বসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত রোববার জেনেভা থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন ফলকার টুর্ক। বিবৃতিটি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় সন্ত্রাসী হামলায় পুলিশের ১৩ সদস্য এবং কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে পৃথক হামলায় হাইওয়ে থানার এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার তাঁর বিবৃতিটিতে বলেন, বাংলাদেশে মর্মান্তিক সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি দেশ কখনোই বহিঃস্থ চাপ সামলাতে পারে না, যখন পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর স্বজনতোষী রাজনীতি ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে অধিকাংশ জনগণকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাসীন মহলের সুবিধা আদায়ের প্রবণতায় জরাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
তাঁরা বলেন, বিকাশমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা জটিলতার মধ্য দিয়ে চলছে। উন্নয়নবিষয়ক আলোচনার পরিসরে ভূরাজনীতি এবং ভূ–অর্থনীতির সঙ্গে জানা এবং অজানার যোগসূত্র রয়েছে। এই চেনা–অজানার বিপত্তি বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিও তৈরি করছে। জটিলতাগুলোকে লাগসইভাবে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক কৌশল অবলম্বন জরুরি।
সেনাপ্রধান ওয়াকার–উজ–জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যত হত্যা হয়েছে, তার বিচার করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন। সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, যারা পুলিশকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তারা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের ছাড় দেওয়া উচিত হবে না।