কোনো প্রাণী বা প্রাকৃতিক কোনো সত্তাকে বিনাশ করে মানুষের বেঁচে থাকা খুবই কঠিন এবং দুঃসহ হয়ে উঠে। পৃথিবীতে উপস্থিত সমস্ত প্রজাতি, জলবায়ু, আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন: সবুজ বৃক্ষরাজি, বায়ু, পানি, মাটি, জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত যা মানুষের স্বাস্থ্য ও মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত।
প্রাকৃতিক পরিবেশের ঠিক বিপরীত হল মানুষ কর্তৃক নির্মিত পরিবেশ। মানুষের হস্তক্ষেপে গড়ে উঠা অঞ্চল যেখানে মানুষ শহর গঠন ও ভূমি রূপান্তরের মতো ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটায়; প্রাকৃতিক পরিবেশ রূপান্তর হয় মানব পরিবেশে। মানব পরিবেশ সৃষ্টি করতে গিয়ে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে নির্মমভাবে সংহার করছে যা জলবায়ু পরিবর্তন ও ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে এবং পৃথিবীতে উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের তারতম্য বা পরিবর্তন ঘটছে। বৈজ্ঞানিকভাবে যাকে “গ্লোবাল ওয়ার্মিং / বৈশ্বিক উষ্ণায়ন” আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং / বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’–এর কারণে মানুষ যে ধবনের অস্বাভাবিক পরিবেশের মুখোমুখি হয় তা হলো:
★ মেরু অঞ্চলের জমে থাকা বরফ গলে যাবে, ফলে সমুদ্রে জলের উচ্চতা বাড়বে এবং সমুদ্র সংলগ্ন স্থলভূমি সমুদ্র গর্ভে চলে যাবে।
★পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি ধ্বংস হবে।
★ মাঠের মধ্যে ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও জীবাণু বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন কমার সম্ভাবনা দেখা যাবে।
★অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
আমরা এখন প্রতিনিয়ত উল্লেখিত অস্বাভাবিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবেশে বসবাস করছি এবং অদূর ভবিষ্যতে তা আরও ভয়ানক আকার ধারণ করবে কোনো সন্দেহ নেই।
উক্ত প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতিতে প্রাচ্যের রাণী খ্যাত নৈসর্গিক চট্টগ্রামের অবস্থা খুবই নাজুক। কারণ:
★অপরিকল্পিত শিল্পায়ন: বেকারত্ব দূরীকরণ ও দেশকে স্বাবলম্বী করতে শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং তারই সুযোগে আমরাও শিল্পায়নের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছি নদ–নদীর উপকূল কারণ কাঁচামাল পরিবহনে স্বল্প ব্যয়, গভীর রাতে মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি না করে উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং গ্রামীণ বাজার থেকে সুলভে শ্রমিক প্রাপ্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব প্রাপ্তির বাইরে সহজে নদীগর্ভে বর্জ্য পদার্থ ছাড়ার অবাধ সুযোগ যা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাবে বাংলাদেশের নদীর উপকূল সংলগ্ন এলাকায়। সংক্ষেপে শিল্পকারখানার অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো মৃতপ্রায়, পাশাপাশি পানি দূষণের কারণে বাস্তুতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের বৃহদাংশ রিভিনিউ আহরণের একমাত্র সূতিকাগার কর্ণফুলী নদী আজ মৃতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। কেবল মানুষ, প্রশাসন, সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও দুর্বৃত্তায়নের কারণে। হালদা নদীও দূষণের খপ্পরে পড়েছিলো কিন্তু অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া তাঁর সতীর্থদের নিয়ে হালদা রক্ষায় জীবন বাজি রেখে লড়ছেন এবং সুফলও আসতে শুরু করেছে। কর্ণফুলী রক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে চটগ্রামবাসীকে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য কর্ণফুলী অচিরেই মৃত্যুর কোলে নুয়ে পড়বে।
★অপরিকল্পিত নগরায়ণ: অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পরিবেশ ও অবকাঠামোগত নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষিজমির বিলুপ্তি, খাবার পানি ও উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশনের সংকট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা, পরিবহন সংকট, বাসস্থানের অভাবে বস্তির সৃষ্টি এবং পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণ, খোলা জায়গা ও বিনোদন ব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে পড়ে ফলে অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো বিস্তৃত হয় জ্যামিতিক হারে। একটি দেশ ও শহরের অর্থনীতিকে কার্যকর রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা যেমন: রাস্তা, সেতু, পানি সরবারহ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ গ্রিড, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ শিল্পোন্নত নয় কিন্তু শিল্পায়নের দিকে অনেকদূর এগিয়ে গেছে এবং তারচেয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রে বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। চোখের সামনে দিনে–দুপুরে নির্বিচারে পাহাড় নিধন ও জলাশয়–পুকুর ভরাট করে অট্রালিকা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। যত্রতত্র আবাসিক এলাকায় ক্লিনিক হাসপাতাল গড়ে উঠছে যা পরিবেশ এবং মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
★অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশে পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি–না আমার জানা নেই। কিন্তু অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত বেশুমার। চট্টগ্রাম অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিমজ্জিত। যত্রতত্র অর্থাৎ নালা–নর্দমা, অলিগলি, সড়ক ও সড়কের পাশে ময়লা আবর্জনা স্তূপ। সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন উপচে পড়ে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা শুধু পরিবেশকে দূষিত করছে না, স্কুল–কলেজগামী ছাত্র–ছাত্রী এবং মানুষের চলাচলকে অসহনীয় করে তুলছে। সিটি করপোরেশনের বর্জ্য অপসারণে অবহেলা যেমন উল্লেখযোগ্য ঠিক তেমনি শহুরে মানুষগুলোর অসচেতনতা ও উদাসীনতাও এই জন্য অনেকাংশে দায়ী। চট্টগ্রাম তথা চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী মুন্সি পুকুর পাড়ে আমার বসবাস। আমি দেখছি, সবাই দেখছে এই পুকুরটি এখন ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে! এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা ও কর্মীদের সুসংগঠিত কার্যক্রম যেমন জরুরি, তেমনি আমাদেরকেও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
★নদী ও পাহাড় দখল: বাংলাদেশে নদী, পাহাড় ও পরিবেশ ধ্বংসের যেনো মহোৎসব চলছে। বাংলাদেশের সব পাহাড়ি অঞ্চল এখন উজাড়। প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রামকে নদী, পাহাড় ও প্রাকৃতিক নিদর্শনের নগর দর্পণ বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু কথিত সেই চট্টগ্রামের সৌন্দর্য নদী ও সবুজাভ পাহাড়গুলোকে এখন আর তার আপন মহিমায় পাওয়া যাবে না অর্থাৎ নদী ও পাহাড়ের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। চট্টগ্রামের নদী, জলাশয় ও পাহাড়গুলো ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। মনে হয়,অচিরেই চট্টগ্রাম ধুধু মরুভূমিতে পরিনত হবে! চট্টগ্রাম একটি অভিভাবকহীন জনপদের নাম।
★ফিটনেস বিহীন যানবাহনের আধিক্য: চট্টগ্রামের সড়কগুলো ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। মানুষ মরছে। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। বিআরটিএ বলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযান চলছে কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল ও ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় অভিযান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে (হাস্যকর)! ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা‘, ব্যাটারি চালিত অটো রিকশায় ভরে গেছে চট্টগ্রাম শহর। চট্টগ্রাম শহর যেনো বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরী। সামপ্রতিক অভিযানে সড়কে ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা কমেছে বটে কিন্তু পুরোদমে উঠেনি। ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা দেখলেই মনে হয় মৃত্যুদূত এসেই গেছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির নির্গত ধোঁয়া ও বিকট হর্নের আওয়াজে চট্টগ্রামের জনজীবন বায়ু ও শব্দ দূষণে আক্রান্ত। জানিনা, এর দায়ভার কে বা কারা নেবে?
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য ধ্বংসের জন্য দায়ী কে বা কি?
★নগরবাসী ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অসচেতনতা ও উদাসীনতা।
★রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে দুর্বৃত্তায়ন ও দখলদারিত্ব।
★বিচারহীনতা ও শক্তিশালী আইন না থাকা কিম্বা বিদ্যমান আইন যথাযথভাবে প্রয়োগে ব্যর্থতা।
চট্টগ্রামকে পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় কিন্তু অবশিষ্ট যা আছে তাকে সুরক্ষিত রাখতে সংস্থা, প্রশাসন ও নগরবাসীকে সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডাঃ শাহাদাত হোসেন একজন চিকিৎসক ও রাজপথের লড়াকু রাজনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রিন, হেলদি এবং সেফ সিটিতে পরিণত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাঁর প্রত্যয় প্রতিভাত হবে যথাসময়ে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি আমরা চট্টগ্রামবাসী। সৎসাহস ও সততা সফলতার মূল মন্ত্র।
লেখক : কবি, পরিবেশকর্মী