মাত্রাতিরিক্ত গরম এখন এই উপমহাদেশে। দিন দিন তাপমাত্রা অসহ্য রকম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিনের বেলায় বেরুনোর উপায় থাকে না। রাতের বেলায়ও গরম অতিষ্ট করে রাখে। ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কঠিন ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন গরম আগ্রাসী অঞ্চল। বিগত কয়েক দশক আগেও এমন সুমিষ্ট ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ ছিল সুন্দর, পরিবেশবান্ধব। অথচ, ক্রমে ক্রমে খোলনলচে পাল্টে ফেলছে ষড়ঋতুর এ–ই দেশ। ভূ–প্রাকৃতিক চেহারা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বলা চলে এখন দুই ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গরম এবং শীতকাল। তবে, অণু বারোমাস গরমকাল –ই বজায় থাকে যেন। শীতকাল শীতে কাবু হওয়ার মত শীত পড়ে না। বড়জোর ডিসেম্বরের শেষের দিকে কিংবা জানুয়ারি মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে শৈত্য প্রবাহের কারণে একটু কনকনে শীত অনুভূত হয়। শৈত্য প্রবাহ হলো, বায়ুর তাপমাত্রার নিম্নগামীতা। শৈত্য প্রবাহ প্রভাবিত হয় যেসব প্রভাবক দ্বারা তা হলো; ক) বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি খ) বাতাসের একটানা বাধাহীন উন্মুক্ত প্রবাহ গ) জলবায়ুগত পরিবর্তন। জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সমগ্র বিশ্ব আজ প্রাকৃতিক হুমকির সম্মুখীন। অসহ্য গরমের আগ্রাসনে বাংলাদেশ পুড়ছে। বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডল সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসে উত্তপ্ত থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উল্লিখিত এই সময়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে বাতাসে যে পরিমাণ জলীয়বাষ্প আসে তা তাপমাত্রা কমিয়ে রাখে। কিন্তু এবার সেই কাঙ্ক্ষিত দক্ষিণা বাতাস স্বাভাবিকের তুলনায় একদম কম। ফলে গরমকালে দক্ষিণা বায়ু প্রবাহের অনুকূলে যে বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা ছিল তা একেবারেই হয় নি। বৃষ্টিপাত হলে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রার উষ্ণতা কমে। দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তুলে ধরেছে, গত ১০০ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এটিকে খোদার গজব ভেবে পরিত্রাণের জন্য মসজিদ মন্দির প্যাগোডায় বৃষ্টির প্রার্থনা করে। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের কেউ কেউ চিরায়ত বিশ্বাসের জোরে গৃহস্থবাড়ি থেকে চাউল তুলে পানি ছিটিয়ে গানবাজনা করে ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দিব মেপে’ গান গাইতে থাকে। তারপর একসময় মেঘ –আঁধার করে ঝর ঝর বৃষ্টি নামে অথবা নামে না। কেউ কেউ দু‘রাকাত ইসতিসকার নামাজ আদায় করে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির জন্য। সম্প্রতি পাবনা জেলার ধর্মপ্রাণ মুসলমান উপরোল্লিখিত নামাজ আদায় করেছে। এটি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। বৃষ্টিও খানিক দেখা দিয়েছিল কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত কোথাও হয় নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একভাগ চিরায়ত বিশ্বাসের জায়গায় তেজস্বী ও বলীয়ান। অন্য বৃহৎ অংশ ধর্মীয় সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত বিশ্বাসী ও চলমান। সর্বনিম্ন অংশ বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তাভাবনা করে, তবে এর অংশ একেবারেই নগণ্য। চিরায়ত ও ধর্মবাদীদের যেমন প্রকৃতির যাবতীয় খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের সুযোগ কম। তেমনিভাবে যারা বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত থেকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করে, নিরন্তর চর্চার অভাবে তারাও সীমিত। বাংলাদেশ উভয় সংকটে থাকে সর্বদা। সিদ্ধান্তহীনতা বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ– এখন ‘ধর্মে আছি জিরাফেও আছি’ তে রয়ে গেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মোকাবিলায় বিশ্ব সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সচেতন ভূমিকা শংসাবাচক বলা যায়। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জাতিসংঘ উন্নত দেশগুলোর কাছে প্রতিবছর অন্তত ১০০ বিলিয়ন ডলার গরিব রাষ্ট্রগুলোকে দেবে এই মর্মে সম্মতি আদায় করেছিলেন। কিন্তু অদ্যাবধি সেটি কার্যকর হয় নি। কিন্তু ঠিকই দক্ষিণ এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের মূল্য দিচ্ছে চরমভাবে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নিজেদের সম্পৃক্ত করে সম্প্রতি লস অ্যান্ড ড্যামেজ নামে একটি তহবিল গঠনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা আসলে বেগতিক। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রকট প্রভাব পড়বে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার ৩ টি দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধারণা করছে বিশ্ব প্রতিকূল জলবায়ু রক্ষাকবচের কর্তাব্যক্তিরা। দেশগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তান। উপরোক্ত তিনটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটের মুখে। তিনটি দেশ আকণ্ঠ বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত। নেপাল ও পাকিস্তান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশ অপর দুই রাষ্ট্রের চেয়ে তুলনামূলক ভালো হলেও সংকট সামাল দেবার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও অর্থবল নেই। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে জনকল্যাণমুখী সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর খুবই কম। এখন আসা যাক মূল কথায়।
তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী কী অসুবিধা হতে পারে তা পরীক্ষা করা যেতে পারে গভীর অনুসন্ধানে। বন্যা দাবানল খরায় দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী সর্বস্ব হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে, প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবে অনেক প্রজাতি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে হুমকির মুখে থাকবে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে জমির উর্বরতা নষ্ট হবে। জমির ফলন কমে যাবে পর্যাপ্ত পানির অভাবে। খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। হিটস্ট্রোকে ধানে চিটা বেশি হতে পারে। গরমের কারণে প্রতিবছর গড়ে ৭০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এসবের আর্থিক মূল্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। মাথাপিছু শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে রয়েছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত উষ্ণতা ও আদ্রতা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। গরম–দূষণে অসুস্থ হয়ে পড়বে মানুষ। হঠাৎ তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে শিল্পায়ন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়। যদিও অনেক ফ্যাক্টরি এখন গ্লোবাল কমপ্লায়েন্স মেনে প্রোডাক্ট অপারেশন করে। তবে বেশ কিছু ফ্যাক্টরির কারণে আমাদের নদীনালা, কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে দেদারসে। ফ্যাক্টরির বর্জ্য ব্যবহৃত কেমিক্যাল, যাবতীয় ময়লা পানি সসাসরি নদী বা খালে যাচ্ছে। এতে নদীর পানি দুষিত হচ্ছে। কলাকারখানা থেকে যে ধোঁয়া প্রতিদিন নির্গত হচ্ছে তা বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষণ করছে। অনেক ফ্যাক্টরির ই টি পি নেই। এ–সব বর্জ্যের কারণে বাতাসে অক্সিজেনের বদলে কার্বনডাইঅক্সাইড এর পরিমাণ বেশি। যা জনস্বাস্থ্যের হুমকিস্বরূপ। একটা দেশ একটা ভৌগোলিক অঞ্চলের পরিবেশ সুস্থ রাখার স্বার্থে সরকারসহ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেতে হয়। দল মত নির্বিশেষে সবারই অংশগ্রহণে পরিবেশ বাঁচাবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সর্বপ্রথম উন্নত বিশ্বকে ভূমিকা নিতে হবে। অস্ত্র বিক্রি গরিব ও মাঝারি সাইজের দেশে এর ব্যবহার ও উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে। স্থানীয় ভৌগোলিক যে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে তা হলো, অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সবুজ বনভূমি গাছপালা রোপনের ব্যবস্থা গ্রহণ। বাড়ির আশে পাশে পুকুরপাড়ে খেত খামার করে সফল সবুজ বিপ্লবে এগিয়ে আসা। গাড়ির সি এফ সি কার্বনিক ধোঁয়া যাতে কম মাত্রায় নির্গত হয় তা নিয়ন্ত্রণ করা। ২০৫০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীর উচিৎ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। যদি কোনোকিছু মান্য না করে অনুরূপ গতিতে চলে তাতে এই শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে যাবে নিশ্চিত। যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসও বাড়ে, তবে দাবানলে পুড়ে ছারখার হবে সবকিছু। খরার কারণে পানি সংকটসহ আবহাওয়া মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। বিশ্বজুড়ে ৩১ শতাংশ গাছ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। অতএব, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও মসনদের চেয়ে দেশ ও ভৌগোলিক পরিবেশ বাঁচানো জরুরি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।