বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের কর্মচারীরা দীর্ঘদিন যাবত অত্যন্ত অল্প মজুরিতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে তাদের মজুরি খুবই কম, যা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব। আয়া মাসীদের বেতন মাসে মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, ওয়ার্ড বয়দের বেতন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা, আর নার্স বা ব্রাদারদের বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ শ্রমিক জীবন জীবিকার তাগিদে একাধিক প্রতিষ্ঠানে বা একই প্রতিষ্ঠানে একাধিক শিফটে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কখনো কখনো তারা তিন শিফটেও কাজ করতে বাধ্য হন, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এই সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছুটি হিসাবে বছরে ১৮/২০ দিনের বেতন নগদায়ন করলেও, কোনো ধরণের সবেতন ছুটি তথা নৈমিত্তিক ছুটি বা পীড়া ছুটি দেওয়ার প্রচলন নেই বললেই চলে। যদি কখনো কোনো শ্রমিকের ব্যক্তিগত ছুটি প্রয়োজন হয়, তবে তাকে অন্য আরেকজনকে বদলি হিসেবে ম্যানেজ করে অনুপস্থিত থাকার অনুমতি নিতে হয়। যা শ্রম আইনের ধারা ১১৫ এবং ১১৬ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও জীবনধারণ উপযোগী মজুরি
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ এর ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক কর্মীর তার নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম, এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৭ম অনুচ্ছেদে ন্যায্য মজুরি ও সম কাজে সমান মজুরি প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক শ্রমিকের জীবনধারণ উপযোগী ন্যায্য মজুরির অধিকার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠিত এবং জাতীয় শ্রমনীতিমালা অনুসারে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক শ্রমমান, অন্যান্য সনদ ও ঘোষণা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের কর্মচারীরা এখনো এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলশ্রুতিতে তাদের মজুরি এতটাই কম যে তা দিয়ে তাদের পরিবার চালানো অত্যন্ত কঠিন এবং কষ্টসাধ্য।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট
জাতীয় শ্রমনীতিমালার ৭ম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে সরকার শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য মানসম্মত জীবন ধারণ উপযোগী মজুরি প্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশে প্রায় ষাটের অধিক সেক্টরের মধ্যে ৪২টি সেক্টরে নিম্নতম মজুরি ঘোষিত হলেও, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে এখনো কোনো নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়নি। অথচ দেশের মোট স্বাস্থ্য সেবার ৭৫ ভাগ পরিচালিত হয় বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের মাধ্যমে। চট্টগ্রামের বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের একমাত্র সংগঠন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্মচারী ইউনিয়ন দীর্ঘদিন যাবৎ এই সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছে।
এই সংগঠনটি তাদের সেক্টরের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি যে যুক্তিসঙ্গত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অধিকাংশ সেবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায়, এই সেক্টরে কমর্রত শ্রমিকদের ন্যায্য ও জীবনধারণ উপযোগী মজুরি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব
স্বাস্থ্য খাত একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে স্বাস্থ্য খাতের অবদান অমূল্য। কিন্তু এই খাতে কর্মরত শ্রমিকরা যদি ন্যায্য মজুরি না পান, তাহলে তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে তাদের কর্মক্ষমতা ও মনোবল হ্রাস পায়, যা প্রকারান্তরে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান কমিয়ে দেয়।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের মানবেতর জীবনযাপন হতে উদ্ধার করতে হলে দ্রুত নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে বর্তমান বাজার দরের সাথে সঙ্গতি রেখে নিম্নতম মাসিক মজুরি ২০ হাজার টাকা ঘোষণা করা জরুরি। এটি তাদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সেবার মানও বৃদ্ধি করবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখা।
নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু বেসরকারি স্বাস্থ্য কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে না, বরং পুরো স্বাস্থ্য খাতের সেবার মানও বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই পদক্ষেপ নেওয়া হলে, স্বাস্থ্য খাতের শ্রমিকরা তাদের কাজের প্রতি আরও উৎসাহী হবে এবং তাদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এটি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতাদের জন্য এবং দেশের জন্যও মঙ্গলজনক হবে।
সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ
বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। তারা যেন কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুবিধা প্রদান করতে হবে। এছাড়াও, তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ এবং সবেতন ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারেন।
সরকার ও মালিক পক্ষের প্রতি আহ্বান
সরকারের উচিৎ বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা এবং তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা। বর্তমান বাজার দর বিবেচনায় একটা চার সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক ন্যুনতম খরচ ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সুতরাং বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান শ্রমিক কর্মচারীদের মাসিক নিম্নতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করা হলে, তারা তাদের পরিবার পরিচালনা করার একটা উপায় খুঁজে পাবে এবং তাদের মানসিক চাপ অনেকাংশে কমবে।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে শুধু শ্রমিকদেরই উপকার হবে না, বরং স্বাস্থ্য খাতের সেবা গ্রহণকারী জনগণও মানসম্মত সেবা পাবে। যার ফলশ্রুতিতে পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্য খাতের সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
সরকার ইতোমধ্যে ৪২টি সেক্টরে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ঘোষণা করেছে। বিগত প্রায় ২ বৎসর পূর্বে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতসহ ১৪টি খাতে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ঘোষণা করার জন্য সার্কুলার জারি করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কাছ থেকে প্রতিনিধির নাম চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তালিকায় সবার উপরে থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি বেসরকারি স্বাস্থ্য সেক্টরে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ঘোষণা করা হয়নি। অথচ সরকার যদি এই পদক্ষেপ নেয় তাহলে কেবল বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন হবে না, বরং পুরো দেশের স্বাস্থ্য খাতের সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্য সেবা খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে তাদের কর্মক্ষমতা ও মনোবল বৃদ্ধি করা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক ও বিলস–ডিটিডিএ প্রকল্পের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক।