মানবিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সেদিন আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম পাশের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। শুধু সামান্য উপহার নয়, কিছু সান্ত্বনার কথা নিয়ে। কিন্তু জানতাম না, সেখানে গিয়ে শুনব এক জীবনের গভীরতম হাহাকার একজন মায়ের চিরচেনা, অথচ প্রায়শই উপেক্ষিত গল্প। সেদিন বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে ছিলেন এক বৃদ্ধ মা। তাঁর চোখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু শান্তির আড়ালে জমে থাকা ব্যথা যেন চাপা ঝড়। আমরা পাশে গিয়ে বসতেই তিনি ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন। সেই কণ্ঠে ছিল সময়ের ক্ষয়, তবু মায়ের মমতার কোমলতা।
তিনি বললেন তাঁর শৈশবের কথা দারিদ্র্যের জাল, অভাবের কাঁটা, অল্প খাবারেও হাসি খুঁজে নেওয়া দিনগুলোর কথা। ছোট থেকেই সংগ্রাম তাঁকে বড় করেছে, কিন্তু কঠোর করে দেয়নি। জীবনের কষ্টকে তিনি শক্তিতে রূপ দিয়েছিলেন। তারপর একদিন নিজের সংসার, স্বামী, সন্তান সবকিছু জুড়ে শুরু হলো নতুন লড়াই। মায়ের সেই গল্পে আমরা শুনলাম এক জীবনের যুদ্ধের প্রতিটি ধাপ। সন্তানকে মানুষ করতে কত রাত তিনি না–ঘুমিয়েছেন, কত বার নিজের প্রয়োজন ভুলে সন্তানের প্রয়োজন সামনে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজের শৈশবকে ভুলে গেছি, যাতে আমার সন্তান তার শৈশব হাসিতে কাটাতে পারে।’
মায়ের কথার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে ছিল অসংখ্য ত্যাগ। এক সময় সন্তানের স্কুলে পাঠানোর খরচ জোগাতে নিজের বিয়ের গয়না পর্যন্ত বিক্রি করেছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে মাঠে কাজ করেছেন, ঘরেও কাজ করেছেন। কিন্তু কখনো অভিযোগ করেননি। কারণ তাঁর কাছে সন্তানের সফলতা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার।
আজ সেই সন্তানই নাকি খুব ব্যস্ত এতটাই ব্যস্ত যে মায়ের শেষ বয়সের ভরসা হতে পারেনি। তাই এই বৃদ্ধাশ্রম এই নীলচে দেয়াল, এই নিঃসঙ্গ দুপুর, এই দুঃখভেজা সন্ধ্যা।
মা হেসে বললেন,
‘সন্তান আমার ভালো আছে এই ভেবেই বেঁচে আছি। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, এত পথ পাড়ি দিয়ে শেষ ঠিকানাটা যদি এখানে না হতো!’
তাঁর চোখের কোনে জমে থাকা জল হয়তো লুকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লুকাতে পারেননি। সেই চোখে ছিল অবহেলার বিষাদ, ত্যাগের আঘাত, এবং মায়ের অটুট ভালোবাসার সবচেয়ে নির্মম প্রতিচ্ছবি।
আমাদের কারো কিছু বলার ছিল না। শুধু নিঃশব্দে বুঝলাম একজন মা কখনো সন্তানকে দোষ দেয় না, শুধু মমতার শেষ আশ্রয়টি হারিয়ে ফেলে। বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর দিন কাটে; দেওয়ালে টাঙানো কয়েকটি ছবি, মাঝে মাঝে সন্তানের ফোন, আর দূর থেকে আসা কিছু স্মৃতি মিলিয়ে।
সেদিন বের হয়ে আসার সময় মনে হলো, কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলাম না, বরং এক সারা জীবনের ত্যাগ আর ভালোবাসাকে একাকীত্বের কাছে হারতে দেখলাম। যদি পৃথিবীর প্রতিটি সন্তান একটু থামে, একটু ভাবে যে মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, তাকে ফেলে রাখা যায় না। যে মানুষটি আমাদের জীবন গড়েছে, তার শেষ আশ্রয় কখনো বৃদ্ধাশ্রম হওয়া উচিত নয়।
আমরা যা দিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, তার চেয়েও বড়ো কিছু নিয়ে ফেরত এলাম এক বৃদ্ধ মায়ের কষ্টভেজা আশীর্বাদ আর জীবনের গভীরতম সত্য: ভালোবাসা যতই নিঃস্বার্থ হোক, অবহেলা তাকে ভেঙে দেয়।












