বৃটিশদের গড়া পটিয়ার চা বাগান

রশীদ এনাম | সোমবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চা পান করতে কে না ভালোবাসে ? চা মন ও দেহকে চাঙ্গা করে। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চা নিয়ে গান রচনার মাধ্যমে কর্মজীবনের ক্লান্তি ভুলবার জন্য চা পানের আহ্বান জানিয়েছিলেন পুঁথিবিশারদ, গণিতবিদ, কাব্যরসিক, চিত্রকর, ভবঘুরে থেকে শুরু করে হিসাবরক্ষকদেরও। রবি ঠাকুর ১৩৩১ সালে ২২ শ্রাবণ শান্তি নিকেতনে একটি চা সভার আয়োজন করেছিলেন। চা চক্রের সুন্দর নামও দিয়েছিলেন “সুসীম চা চক্র”

পৃথিবীতে চা এসেছিল যেভাবে ২৭৩৭ খ্রি. দিকে চীনের রাজা শেন নংয় একটা গল্প আছে। এক গভীর বনে গিয়ে রাজা শেন বনের গাছের বাকল আর পাতা চিবিয়ে স্বাদ নিচ্ছিলেন। একসময় রাজা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। হঠাৎ বাতাসে ভেসে একটি পাতা তাঁর মুখে পড়ে। শেন পাতাটি চিবিয়ে খাওয়ার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন। পাতাটি ছিল নাকি চা গাছের পাতা। সে পাতা আবিষ্কার হওয়ার পর ছয় হাজার বছর আগে চীনে চায়ের চাষ শুরু হয়েছিল। তবে চা গবেষকরা বলেন সে সময় চা পাতাকে শাক হিসেবে খাওয়া হতো। চীনেই চাকে পানীয় হিসেবে গ্রহণ করা শুরু হয় দেড় হাজার বর আগে। চা পাতা গরম করে পানিতে মিশিয়ে নিলে চমৎকার এক পানীয় তৈরি হয়। চীনারা সেই পানীয়ের নাম দেয় “মৌচা”। নবম শতকে টাং সাম্রাজ্যের সময় এক বৌদ্ধ ভিক্ষু পথম চীন থেকে একটি চা গাছ নিয়ে জাপানে চা চাষ শুরু করেন। চীনের পাশাপাশি জাপানেও চায়ের প্রচলন শুরু হয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে ওলন্দাজ বণিকেরা বিপুল পরিমাণে চা চীন থেকে ইউরোপে আমদানি করে। পরবর্তীতে চা গবেষকরা বলেন। চাকে পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেয়ার কাজটি করেছেন। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় চালর্সর স্ত্রী রানি ক্যাথেরিন দ্য ব্রাগাঞ্জার। ১৬৬১ সালে চালর্সকে বিয়ে করে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। সে সময় ক্যাথেরিন একগাদা চা পাতা যুক্তরাজ্যের রাজদরবারের পানীয় হিসেবে চায়ের প্রবেশ ঘটে। সতেরো শতকের দিকে যুক্তরাজ্যে থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতবর্ষ এবং পুরো বিশ্বে সতেজ পানীয় চা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

একদিন খুব কাছের আত্মীয় মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম মামার কাছ থেকে জানতে পারি পটিয়ায় একসময় ব্রিটিশদের হাতে গড়া চা বাগান ছিল। এটি চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূবে। একদিন সাংবাদিক তৌকিরসহ চা বাগান পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। পটিয়া রওশনহাট নেমে ব্রীজের পরে পটিয়া চন্দনাইশন আরকান সড়কের ঠিক পূর্ব পাশে হযরত শাহ সাহেব কেবলা (.) মাজার গেইট দিয়ে যে রাস্তাটি সোজা চলে গিয়েছে। সে পথ ধরে কিছুদূর পেরিয়ে গেলে পটিয়া টি এস্টেট। যাওয়ার পথে দেখা মিলবে ইশকুল, মাদ্রাসা, ইটের ভাটা, ছোট একটা মাটির টান নামে পার্কও হয়েছে। ইটের ভাটার লম্বা চিমনী দিয়ে শুভ্র ধোয়া বের হচ্ছে কুন্ডলী পাকিয়ে। কাঁচা ইটের সারি। কাঁচা ইট তৈরির জন্য কাদা মাঠির স্তুপ করে রাখা হয়েছে। মাটির কুঁড়ে ঘর, পাশে কাঞ্চনাবাদ “আব্বাসপাড়া উপ আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়”। কিছুদূর গেলে চোখে পড়বে মিঞ্জিরা খাল, খাল পার হয়ে একটু দূরে গেলে পটিয়া টি এস্টেট ও চা বাগান। চা বাগানের আশেপাশে আম, জাম, লিচু পেয়ারাসহ নানা জাতের ফলের বৃক্ষ। দূরে পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে পেয়ারা বেগান। সমগ্র দেশে কাঞ্চনাবাদের পেয়ারা বেশ বিখ্যাত। খেতে বেশ কচকচা ও মিষ্টি। চা বাগানের শ্রমিকের মেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য সন্ধ্যা রানীর জন্ম চা বাগান এলাকায় । ১৯৬২ সালে তাঁর জন্ম। সে বলল, দাদার কাছে শুনেছেন, এই এলাকায় ব্রিটিশ নাগরিক হেকিম সাহেবের চা বাগান ছিল। ১৮২৭ সালে প্রায় ১৫২৬ একর জমির ওপর চা বাগানটি করা হয়। পটিয়ার শেষ সীমানা চন্দনাইশের শুরু বলা যায়। প্রায় ৩০০ শ্রমিক চা বাগানে কাজ করতো। সেসময় বছরে প্রায় ৫ থেকে ৭ মেট্রিক টন চা উৎপাদিত হতো। পটিয়া দক্ষিণ পূর্বঞ্চলে সবুজ পাহাড়ঘেঁষে টি এস্টেটটি স্থাপন করা হয়েছিল। চা বাগানের বেশ কিছু স্মৃতি আছে। সন্ধ্যা রানী দুটি চা গাছ দেখালেন। কিছু দূরে গভীর বনে আজো কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় ২৫টির মতো চা গাছ।

বৃটিশ নাগরিক পার্ল, হেকিম সাহেবের বাংলো ছিল। হেকিম সাহেবেরে পরে আসেন, ভারতের ভগীন্দ বাবু, সুভাষ বাবু ও খান বাহাদুর মণী এরাই ছিলেন মূলত চা বাগানের মালিক। পার্ল ও হেকিম সাহেবের আদিকালের বাংলো ছিল। নির্জন পাহাড়ি এলাকায় একসময় নান্দনিক অট্টলিকা ছিল তার ভগ্নবশেষ দেখলে বুঝা যায়।। বাগানের অন্য পাশে চা কারখানা। চা কারখানার দেয়ালের ভগ্নাবশেষ আছে। একটু সামনে গিয়ে দেখা মিলল, ১৯৬৬ সালে এম কে দাশ বর্মা নাথ নির্মিত গভীর কূপ। এ কূপের পানি পান অনেকে পান করে। বর্তমানে কূপের পাশে একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। কূপটি অনেকটা লতাপাতায় ঢেকে আছে। চা বাগান এলাকায় শুরুর দিকে প্রায় ৩৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক চা বাগানে কাজ করতো। পটিয়া কচুয়াই এলাকায় ঢের নামে এক জাতীয় গোষ্ঠীও ছিল। যারা চা বাগানে কাজ করতো। পটিয়া চা বাগানে একসময় উৎপাদন প্রক্রিয়াও ভালো ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে প্রায় ৬০০ একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করেন। চা বাগানটি বাংলাদেশ টি কোম্পানি লিমিটেড পরিচালনা করতো। কালের বিবর্তনে ১৯৭৯ সালের দিকে চা বাগানটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে চা বাগান শ্রমিকরাও অন্যত্র চলে যায়। চা উৎপাদন চালু করা সম্ভব হয়নি। কিছু শ্রমিকরা অনেকে এখানে কুঁড়ে ঘর করে স্থায়ীভাবে বসত ভিটা তৈরি করেছে। পরবর্তীতে টি এস্টেট এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে “জীবন জয়ের পথে” শ্লোগান নিয়ে চন্দনাইশ উপজেলার মোহাম্মদ রফিক, ওয়াসিম, জ্যোতি হোর, সুজা আল মামুন, মেজবাহ, নিলয়, শান্তা, মাহাফুজা জাহান, নাছিমা সিরাজী ও অনিকে চৌধুরীসহ একদল স্বপ্নবাজ তরুণ গত ২০০৪ সালে “স্বপ্ননগর” একটি সামাজিক সংগঠন যাত্রা শুরু করে এদের কার্যক্রম ছিল প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও খেলাধুলা, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য সচেতনতা, মাধ্যমিক শিক্ষায় সহায়তা প্রদান। বর্তমানে “স্বপ্ননগর বিদ্যা নিকেতন” প্রাথমিক বিদ্যালয়টি শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে চা বাগান এলাকায়। ইশকুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শুরুর দিকে ছনপাতা তৈরি হলেও একটি দৃষ্টি নন্দন নকশায় একটি নান্দনিক ভবন হয়েছে। ব্রিটিশদের গড়া পটিয়ার চা বাগানটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চা বাগান নেই আছে শুধু জরাজীর্ণ টি এস্টেটের কিছু ভগ্নাবশেষ ও পাহাড়ের পাদদেশে কিছু চা গাছ।

লেখক: সমন্বয়সহকারী ইতিহাসের খসড়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধসিগিরিয়া শ্রী লঙ্কার পাথুরে বিস্ময়