বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান উপমহাদেশের তিনটি দেশেই যে ক্লেপটোক্র্যাটিক বা গণতন্ত্রের নামে দুর্বৃত্তায়িত, চোর্যবৃত্তি, ঘৃণা ও জিঘাংসার শাসনের ধারা চলছে, লোভাতুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক শাসক গোষ্ঠীর অবাধ ও অবৈধ অনাচার চলছে সে কঠিন মুহূর্তে নিঃস্বার্থভাবে আত্মনিবেদিত পরিচ্ছন্ন ও সাধারণ যাপিত জীবনের নৈর্ব্যক্তিক আত্মসন্তষ্টিতে পরিতৃপ্ত ওপার বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসান প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম বাংলার একটি মানবিক সর্বত্যাগী রাজনৈতিক প্রজন্মের প্রায় অবসানের সূচনা করল।
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, কৃতী রাজনীতিবিদ, মনে–মননে আমৃত্যু বিপ্লবী, বিশিষ্ট কবি, ও সাহিত্যিক সর্বোপরি অন্তরে–বাহিরে প্রকৃত অর্থেই এক পরিচ্ছন্ন মানুষ বুদ্ধদের ভট্টাচার্য ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলেই দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান হয় বহুমুখী চক্রান্ত, মমতার নাটকীয় পপুলিজম, বামফ্রন্টের অতি আত্মবিশ্বাস সহ নানা কারণে কিন্তু কোন অবস্থাতেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত ও ভ্রান্ত নীতির কারণে নয় বরং কেন্দ্র থেকে রাজ্য পর্যন্ত অপপ্রচার, দীর্ঘদিনের শাসনের পর মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাজাত অপরিণামদর্শী ভাবনার প্রভাব প্রভৃতির কারণে, যা আজ পশ্চিম বঙ্গের মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায়, ব্যাপক দুর্নীতি, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তৃতিতে, অস্বস্তিকর অবনতিশীল বিভক্ত সমাজ মানসের মধ্যে নিরন্তর উপলব্ধি করছে। অথচ দীর্ঘ শাসনের পর বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বাম ফ্রন্ট সরকারের তিনি সহ তাঁর মন্ত্রীসভার কোন সদস্য বা ফ্রন্টের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারো বিরুদ্ধে কেন্দ্র বা তীব্র বাম বিরোধী, অনায়াসে অসত্য বলতে পটীয়সী তিনবারের মুখমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্নীতি বা অপকর্মের কোন অভিযোগ আনতে পারেননি যা এখন মমতার মন্ত্রী, নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মমতারই এক সময়ের রাজনৈতিক মিত্র বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্ত সংস্থাগুলো একের পর এক আনছে এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ প্রথম সারির তৃণমূল নেতারা অনেকেই এখন জেলে। শুধু ভোটের হিসাবে তোষণের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিদ্বিষ্ট পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গ আজ সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ক্রমে অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে। অথচ দীর্ঘ বাম শাসনে সারা ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে, সারা ভারতে দাঙ্গা হলেও কোনো সময়ে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোনো সহিংসতা হয়নি শুধু প্রশাসনিক দৃঢ়তার জন্য নয় শাসক বামদলগুলোর ক্যাডারদের অসাম্প্রদায়িক মনন ও প্রতিজ্ঞার জন্য। ফলে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যা লঘুদের দীর্ঘদিন ধরে দেশ ত্যাগের প্রশ্নই উঠেনি।
১৯৪৪ সালে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাংলা সাহিত্যের কিশোর কবি খ্যাত সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর পিতৃব্য। প্রেসিডেন্সী থেকেই তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি নেন। তখন কলেজ ষ্ট্রীট, কফি হাউজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছিল বাম রাজনীতিতে নিবেদিত টগবগে তারুণ্যের দীপ্তিতে প্রোজ্জ্বল। তিনি ইতোমধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী থেকে নেতায় পরিণত হয়েছেন। অন্যদিকে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের সৃজনশীল লেখক–শিল্পীদের আড্ডায় যাচ্ছেন নিয়মিত। সুনীল, শীর্ষেন্দু ছিল তাঁর আড্ডার সাথী। ঠিক এ সময়েই মস্কো–পিকিং মতাদর্শগত সর্বনাশা বিরোধের জেরে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তি নেমে আসে। তারই প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের ১১০ সদস্যের মধ্যে ৩০ জন বেরিয়ে এসে আলাদা পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সংক্ষেপে সিপিএম প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তসহ বাংলার অধিকাংশ নেতাই এই নতুন দলে যোগ দেন। এই ডামাডোলের মধ্যে ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টচার্য পাটির সদস্য পদ লাভ করেন ও সার্বক্ষণিকভাবে বিপ্লবী রাজনীতির কাজে নিজেকে সঁপে দেন। ১৯৬৭ সালে দুই কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেসের একটা অংশ অজয় মুখার্জির বাংলা কংগ্রেস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা প্রথমবারের মত ক্ষমতায় যায় ও যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সেই সরকার ভেঙে দেয়। শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে এক অরাজক পরিস্থিতি। একদিকে শাসকদল কংগ্রেস, অন্যদিকে দুই কমিউনিস্ট পার্টির জমি ও ভাতের লড়াই আর সিপিএম থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি অংশ তথা নকশালীদের সন্ত্রাস। এমতাবস্থায় ১৯৭২ সালে কারচুপির নির্বাচনে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় কংগ্রেসের রাজ্য সরকার। কিন্তু তাদের নিপীড়নে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। এই গণঅসন্তোষ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিল সিপিএম। ১৯৭৫ সালে জারি করা কুখ্যাত জরুরি অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে প্রায় হীনবল করে তুলে। ১৯৭৭ সালের মার্চে বিধান সভা নির্বাচনে সিপিএম এর নেতৃত্বে বামদলগুলোর ঐক্যমোর্চা বা বামফ্রন্ট নিরুংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে, গঠিত হয় জ্যোতিবসুর নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট সরকার। ১৯৬৬ থেকে ’৭৭ সাল এই পুরো সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে পার্টি ও দেশের কাজে সার্বক্ষণিক ভাবে উৎসর্গ করে রেখেছিলেন। ক্ষমতায় এসেই মমতার মত কোনো চমক বা ভাতা দিয়ে মানুষের সাময়িক মন জয় নয় বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে প্রথমেই কৃষি সংস্কারে হাত দেয় ও ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বণ্টনের কঠিন কাজকে সম্পন্ন করে গ্রাম বাংলায় কৃষি পুনর্জাগরণ সংঘটিত করে। এতে গ্রাম বাংলা বামপন্থীদের অভেদ্য দুর্গে পরিনত হয়। এর পরেই শিক্ষা জাতীয়করণ করে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের জীবিকা নিশ্চিত করে। পাল্টে যায় পশ্চিম বঙ্গের জনজীবন ও রাজনীতির চালচিত্র। এর ফলে পর পর সাতটি নির্বাচনে বামপন্থীরা সহজে জিতে।
জ্যোতি বসু বয়সের কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ায় প্রথমে ১৯৯৮ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে উপমুখ্যমন্ত্রী ও শেষ পর্যন্ত ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। তখন পশ্চিম বঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতিতে স্থবিরতা শুরু হয়েছে, অনেকটা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মত পার্টি ও সরকার প্রায় একাকার হয়ে যায়। ফলে দলীয় আমলাতন্ত্র বিকশিত হতে শুরু করে এবং তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদের বাড়াবাড়ি ও দুর্নীতি শুরু হয়। বুদ্ধদেব এসব থেকে সরকার ও পার্টিকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হন। তিনি বুঝতে পারেন কৃষির সংস্কার শুধু নয় প্রয়োজনে ব্যক্তি পুঁজির বিনিয়োগে আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে রাজ্যের বেকার সমস্যা সমাধান ও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য। তাঁর প্রচেষ্টায় টাটা, ইনফোসিস, জিন্দাল ও বেশকিছু বিদেশী শিল্পগ্রুপ নির্দিষ্ট শর্তে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নে এগিয়ে আসে। রাজার হাটের নিউ টাউনে আই.টি হাব গড়ার উদ্যোগ নেন। সিঙ্গুঁর ও নন্দীগ্রামের মত পশ্চাদপদ এলাকায় বিশাল শিল্প এলাকা গড়ে তোলার কাজ হাতে নেয়া হয় এবং ইচ্ছুক জমির মালিকদের যথোপযুক্ত ক্ষতি পূরণ দিয়ে দ্রুত টাটার উদ্যোগে সিঙ্গুঁরে গড়ে উঠে বিশাল মোটরগাড়ি কারখানা। ঠিক এ সময়েই কেন্দ্র ও মার্কিন চক্রান্তে মমতা অনিচ্ছুক বলে কথিত জমির মালিকদের পক্ষে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে ও মুসলিম অধ্যুষিত নন্দীগ্রামে এটাকে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের রং চড়িয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে এ আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে তা দমন করতে গিয়ে বলপ্রয়োগ করে সরকার বেকায়দায় পড়ে। মিথ্যা অপপ্রচারে ভেসে যায় রাজ্য। অবশেষে ২০১১ সালের নির্বাচনে শতকরা ৪০ ভাগ ভোট পেয়েও পরাজিত হল বুদ্ধদেবের রাজ্য সরকার। ইতোমধ্যে মমতা বিজেপিকেও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক স্পেস করে দেয় দমদম থেকে বিজেপি প্রার্থী তপন সিকদারকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে। বাম আমলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ সংঘ পরিবার বাংলায় শক্তি বাড়ানোর সুযোগ পায়নি কিন্তু মমতার আমলে তারা শক্তিশালী হয়ে মমতাকেই এখন চ্যালেঞ্জ করছে। পশ্চিম বঙ্গে শিল্পায়ন বন্ধ করে টাটা সহ অন্যান্য শিল্পগ্রুপ চলে যায়। সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম যে তিমিরে ছিল এখনো সেই তিমিরেই আছে। মমতার বারংবার আশ্বাসেও তারা ফিরছে না। পশ্চিম বাংলার মানুষ এখন নিজেদের ভুল বুঝে উল্টো বিজেপির দিকে ঝুঁকে আরো মারাত্মক ভুলের দিকে এগিয়ে চলেছে।
২০০৩ সালে বুদ্ধদেবকে খুব ঘনিষ্ট ভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার, দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে এক শিক্ষক সম্মেলনে। সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনের মাঝামাঝি তিনি এসে পৌঁছান। কোনো আড়ম্বর নেই, প্রটোকলের হুড়োহুড়ি নেই। হঠাৎ দেখি একটি সাধারণ প্রাইভেট কার থেকে তিনি নামলেন। তিনি লাফার্জ সিমেন্ট কোম্পানীকে কারখানা করার জন্য জায়গা দিয়েছেন তখন। কথা প্রসঙ্গে বললেন কোম্পানীর একটি বিজ্ঞাপনের আপত্তির কথা তিনি তাদের জানিয়েছেন যাতে লেখা ছিল ‘আপনার বাড়ী, আপনার পরিচয়’। তিনি নাকি তাদের বলেছেন, ‘আমার তো কোন বাড়ী নেই কলকাতা শহরে, তাহলে আমি কি পশ্চিম বাংলায় পরিচয়হীন’? তারা সেটা পরে সংশোধন করে নেন। এটা শুধু প্রতীকী কথা মাত্র নয় আদতে পশ্চিমবঙ্গের ২২ বছরের মন্ত্রী, ১২ বছরের একজন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বাবুর নিজের কোন বাড়ি ছিল না। পাম এভেনিউর দুই কামরার ভাড়া করা একটি ছোট ফ্ল্যাটেই তিনি থাকতেন। বই পত্র পত্রিকায় ঠাসা তাঁর রুমে গেলে কেউ বিশ্বাস করতে পারত না মন্ত্রী বুদ্ধদেব, সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব এ ভাবে থাকতে পারেন। তিনি যাপন করেছেন এক পরিমিত জীবন, লালন করেছেন সুস্থ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। রবীন্দ্রনাথ ও সুকান্তের কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন অনর্গল। কবিতা লিখতেন, কবিতা পড়তেন। মার্কসবাদী দর্শনে ছিলেন পারঙ্গম। শেষজীবনে লেখা একটি বই ‘স্বর্গের নীচে মহা বিশৃঙ্খলা’ তে চীনের সমাজতন্ত্র নির্মাণের ত্রুটি ও পার্টির আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও গতি প্রকৃতি নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করেছেন। ২০২২ সালে মোদি সরকারের দেয়া ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি তিনি প্রত্যাখান করেন। জীবনে কখনো অশুভ শক্তির সাথে আপস করেননি। ২০১৫ সালে ব্রিগেডের বিশাল সমাবেশে জীবনের শেষ ভাষণে পার্টির নেতা কর্মীদের প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল, ‘সামনে লড়াই এগিয়ে যাও’। সেই লড়াই এখন তাঁর পার্টি করে চলেছে তাঁকে ছাড়া। প্রায়ই তিনি রবি ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন সভায়–সমাবেশে–
‘পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নতুন উঠবে ফুটে
জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।’
জীবনের ফুল ফোটানোর নিরন্তর সংগ্রাম আমৃত্যু করে গেলেন তিনি। মরণেও দলমত নির্বিশেষে রাজ্যবাসীর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায় শায়িত হলেন। নশ্বর দেহটাও জ্যোতি বাবুর মত দান করে গেলেন মানুষের জন্য।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।