উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদী শক্তির ক্রম উত্তরণ ও বাঙালির নব জাগরণে ইংরেজ শাসক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে দুই ভাগ করেছিলেন। এটাই ‘বঙ্গভঙ্গ’ বলে পরিচিত। ১৯১১ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জ আসেন ভারতে এবং দিল্লীর দরবারে বসে বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা করেন। বঙ্গভঙ্গ আইন বিলুপ্ত করার এ বছরেই অর্থাৎ ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের ধলঘাটে জন্ম নেন প্রীতিলতা, যাঁকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের আপোষহীন নেত্রী, উপমহাদেশের প্রথম নারী শহিদ।
বাবার নাম জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের প্রধান কেরানী। জগদ্বন্ধু শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর পৈতৃক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া ত্যাগ করে মায়ের সাথে পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে চলে আসেন। প্রীতির মা প্রতিভা দেবী ছিলেন গৃহিনী। তাদের পরিবারে ছয় সন্তানের জন্ম হয়– মধুসূদন, প্রীতিলতা, কণকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ।
বিখ্যাত বিপ্লবী ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রয়াত কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁর ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ নামে জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন প্রীতিলতা আমার সহোদর ছোট বোনের মতো। তার জন্ম আমাদের গ্রামের বাড়িতেই। গ্রামের বাড়ি বলতে ধলঘাটকেই বুঝিয়েছেন। তারপর হয়তো বাবার চাকুরি সূত্রে শৈশবে তাদের পরিবার ওই আসকার খাঁর দীঘির দক্ষিণ পশ্চিমে বসতি স্থাপন করে থাকবেন। আমরা এখন প্রীতিলতাকে নিয়ে রচিত উপাখ্যানে তাঁর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরব। যেমন প্রীতিলতা কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য নির্দয়ও হতে পারতেন। তিনি মেধাবী ছিলেন, কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রির ব্যাপারে মোহশূন্যও ছিলেন। তিনি নারী ছিলেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন সবদিক দিয়ে পুরুষের সমকক্ষ হতে এবং হয়েও ছিলেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবে একনিষ্ঠ বিশ্বাসী, আবার তিনি একনিষ্ঠ ঈশ্বর বিশ্বাসীও ছিলেন।
বিপ্লবী ও গবেষক পূর্ণেন্দু দস্তিদার তার গ্রন্থে প্রীতিলতার শৈশব নিয়ে লিখেছেন, ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতার মন যে কারো উপর অত্যাচার দেখলেই ব্যথিত হত। যেদিন বাড়ির পাশ দিয়ে মাস্টারদা সূর্যসেনকে পুলিশ মারতে মারতে ধরে নিয়ে গেল সেদিন থেকেই প্রীতিলতার শিশুমন বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে।
প্রীতিলতার লেখালেখির সূত্র ধরে তাঁর বিপ্লবী জীবন নাট্যের ক্রমবিকাশের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ আমরা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি:
* তিনি বাল্যকালে ডা. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়ে যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বিপ্লবী পরিষদের কথা শোনেন
* মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ওই বিপ্লবী পরিষদের অন্য চারজন সদস্য ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ ও নির্মল সেন। পরবর্তীকালে এর নামকরণ হয় Indian Republican Army চট্টগ্রাম শাখা। প্রীতি এই শাখার সদস্য ছিলেন
* ডা. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রী থাকাকালে তিনি শুনেছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত একনেতা বিপ্লবী সূর্যসেনের কথা এবং দ্রুতই তিনি তাঁর ভক্তে পরিণত হন
* এরপর যখন তিনি ঢাকায় এসে ইডেন কলেজে ভর্তি হলেন তখন থেকে তাঁর স্বপ্ন ছিল নিজেকে মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথী হিসাবে গড়ে তোলা। ১৯৩০ সালে তিনি আই,এ পাশ করেন। ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।
* ১৯৩০ সালের এপ্রিলের যুববিদ্রোহ তাঁর চিত্তকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি শুধু ছোটখাট খবর আনা–নেওয়া, বিপ্লবীদের শেল্টার প্রদান– এসব কাজের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ থাকতে চাইলেন না। আরো বড় দায়িত্বের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।
* এই অবস্থায় তিনি বি,এ পড়ার জন্য কলকাতায় বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে বি,এ পরীক্ষার পর তিনি দ্রুত চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
* চট্টগ্রামে এসে এবার অবশেষে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী সূর্যসেন ও নির্মল সেনের সংস্পর্শে আসেন। গোপন আশ্রয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ হয়।
১৯৩২ সালে মাস্টারদা’র সঙ্গে প্রীতির প্রথম দেখা হয় ধলঘাটে, সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে। এই গোপন আশ্রয়ে ছিলেন নির্মল সেনও। খবর পেয়ে হঠাৎ সন্ধ্যার সময় ক্যাপটেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে সৈন্যরা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল। দুই পক্ষের গোলাগুলির এক পর্যায়ে নিহত হলেন ক্যামেরন। এই আক্রমণে নির্মল সেন এবং ভোলা নামের একটি ছেলেও প্রাণ হারান। প্রীতিলতা চেয়েছিলেন নির্মল সেনের সঙ্গে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে। কিন্তু মাস্টারদা সূর্য সেন তাঁকে নিবৃত্ত করেন এবং অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
মাস্টারদা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে নৈশ আক্রমণ করা হবে। এই অপারেশনের সার্বিক নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে প্রীতিলতাকে। তারিখ ঠিক হয়েছে ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। ‘তখন গভীর রাত। নাচ–গানে মুখর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব। প্রায় ৪০ জন শ্বেতাঙ্গ নারী–পুরুষ এই আনন্দ উৎসবে মত্ত। দূরে, ক্লাবের মেইন গেইটে একজন পুলিশ সার্জেন্ট, একজন হাবিলদার ও চারজন সৈনিক পুলিশ পাহারায় রয়েছে। এদের সামনে দিয়েই দারোয়ান বেশে মহেন্দ্র চৌধুরী ও সুশীল দে পায়ে হেঁটে এগিয়ে ক্লাবের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।… কয়েক জায়গায় চোখের পলকে বসানো হলো টাইম বোমা। সময় অনুযায়ী গাড়োয়ান বেশের মহেন্দ্র ও সুশীল একত্রে যখন জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তখন একই সময়ে প্রীতিরা রিভলবার থেকে সমানে ক্লাবের নির্দিষ্ট ঘর লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। বোমা ও গুলির শব্দে, ধোঁয়ায় পুরো এলাকা অন্ধকার, ধোয়াশাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় হয়ে উঠল। শ্বেতাঙ্গ নারী পুরুষেরা আতঙ্কে চিৎকার করে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে পালাতে চেষ্টা করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অপারেশন শেষ হয়ে যায়। হুইসেল দিয়ে সবাইকে একত্রিত করে প্রীতি থাকলো পেছনে। হঠাৎ করেই তার দেহে এসে লাগলো গুলি। হাটু ভেঙ্গে লুটিয়ে পড়ে প্রীতি। জীবিত অবস্থায় ধরা দেবেন না। তিনি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শার্টের বাঁ পকেটে রাখা সাইনাইড ক্যাপসুলটা বের করে মুখে দেয়। একসময় হাতটা মাটিতে পড়ে যায় নিথর ভঙ্গিতে। একই সঙ্গে ইতিহাসের সবুজ পৃষ্ঠায় উঠে যায় বাংলার প্রথম বিপ্লবী নারী শহিদের নাম: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
মৃত্যুর আগে যে বিদায় বাণীটি তিনি লিখে রেখে যান– তার যে অংশটি বর্তমান নারীবাদীদের জন্য প্রাসঙ্গিক, তা এখানে তুলে ধরা হলো:
‘দেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিণীরা কেন উহা পারিবনা?… সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেন ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?… সশস্ত্র ভারতীয় নারী ও সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন– এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।’
লেখক : নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত যাত্রাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, গবেষক।